আপনাকে যদি প্রশ্ন করি যুক্তরাষ্ট্র কেন জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা চালিয়েছিলো? তাহলে আপনার উত্তরটা হবে খুবই সহজ। কিছুটা এরকম, যুক্তরাষ্ট্র জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা চালিয়েছিলো কারন যুক্তরাষ্ট্র ছিলো মিত্রশক্তি; বিপরীতে জাপান ছিলো অক্ষশক্তি তাই জাপানে যুক্তরাষ্ট্র পারমানবিক বোমা হামলা চালিয়েছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক বোমা হামলা চালানোর পেছনের কারন ছিল একদমই আলাদা।

জাপানে পারমানবিক বোমা হামলার জন্য জাপান নিজেই কেন দায়ী এ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে “দ্যা গ্রেটার এশিয়া” সম্পর্কে।

১৯৩০ সালের দিকে জাপান ঠিক করে তারা পুরো এশিয়াতে নিজেদের জাপান সাম্রাজ্যে স্থাপন করবে। পূর্ব এশিয়া এরপর দক্ষিণ এশিয়া সহ পুরো এশিয়া নিজেদের দখলে আনবে। ১৯৩১ সালে চীন আক্রমণের মধ্যদিয়ে জাপান “দ্যা গ্রেটার এশিয়া” এর সূচনা করে। জাপান নানা সময়ে চীনের কিছু অংশ সহ উত্তর কোরিয়া, সাউথ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমারে আক্রমন করে এবং নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে।

পৃথিবী আজকের জাপানকে যতটা ভদ্র এবং নম্র হিসেবে জানে, অতীতে জাপান ছিলো ততটাই নির্মম, বর্বর, অমানবিক জাতি! জাপান যে দেশেই উপনিবেশ স্থাপন করতো সেখানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সম্পদ লুট পর্যন্ত কোনো কিছুই বাদ দেয়নি।

মানচিত্রে জাপান সাম্রাজ্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এশিয়াতে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি ছিলো। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া ছিলো ফ্রেঞ্চ কলোনি, মালয়েশিয়া ছিলো ব্রিটিশ কলোনি এবং ইন্দোনেশিয়া ছিলো ডাচ কলোনি। জাপান এসব দেশ আক্রমন করলেও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং মালয়েশিয়া আক্রমন করে সরাসরি ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্যেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং জাপান মিত্রশক্তির শত্রুতে পরিনত হয়।

জাপান সে সময় পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশে আক্রমন করলেও ফিলিপাইনে কখনই আক্রমন করেনি। কারন ফিলিপাইন ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি। এতক্ষণ পর্যন্ত জাপান নিজেদের গ্রেটার এশিয়া তৈরি করার দিকে ঠিক ঠাক আগাচ্ছিলো কিন্তু অপ্রতিরোধ্য জাপান নিজেদের সামর্থ থেকে বড় কিছু করতে যায় আর সেটা হলো ফিলিপাইনে আক্রমন করার পরিকল্পনা। জাপান জানত যদি ফিলিপাইনে জাপান আক্রমন করতে চায় তাহলে তারা কখনই সফল হবেনা কারন যুক্তরাষ্ট্র ছিলো জাপান থেকে শক্তিশালী দেশ। কিন্তু জাপান পরিকল্পনা করে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করার এবং এরপর নির্বিঘ্নে ফিলিপাইনে আক্রমন করার।

১৯৪১ সালে জাপান হঠাৎ ই নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত আমেরিকার বিমান ও নৌ-ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। জাপানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো পার্ল হারবারে আক্রমন করার মাধ্যমে আমেরিকান নেভিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া। তবে জাপান পার্ল হারবারে আক্রমন করে ঠিকই কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এ হামলার পরেরদিন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।

পার্ল হারবারে হামলা

১৯৪১-১৯৪৫ সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাজ্যের সাথে মিলে এডলফ হিটলার, ইতালি এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে ইতালির আত্নসমাপর্ন এবং হিটলার সুইসাইড করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষের পথে তখন অক্ষশক্তির বাকি দেশগুলো আত্নসমাপর্ন করলেও জাপান তাতে রাজি ছিলোনা এবং যুদ্ধ চালিয়ে যায় নিজেদের “দ্যা গ্রেটার এশিয়া” তৈরির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য। বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির জন্য জাপানকে থামানোর প্রয়োজন ছিলো কিন্তু জাপান আত্নসমাপর্ন অথবা সমঝোতা কোনোটাই করতে রাজি ছিলোনা।

জাপানকে থামাতে যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে অপারেশন “ডাউনফল”। এই অপারেশন ডাউনফলের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো জাপান দখল করা অথবা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা। অপারেশন ডাউনফল এর প্রথম অপারেশন হিসেবে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপে আক্রমন করে যুক্তরাষ্ট্র। এই আক্রমন ব্যাটল অফ ওকিনাওয়া নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিলো যে এর নাম দেওয়া হয়েছিলো “রেইন অফ স্টিল” এ যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ ছিলো তা বুঝার জন্য ডিরেক্টর মেল গিবসন এবং অভিনেতা এন্ড্রু গারফিল্ড এর “হ্যাক’স রিজ” সিনেমা’টি দেখলেই বোঝা যায়। উক্ত সিনেমা’টি তৈরি করা হয়েছে এই ব্যাটল অফ ওকিনাওয়া’র উপর ভিত্তি করেই।

ওকিনাওয়া দ্বীপে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী

এ যুদ্ধে ১০০,০০০ জাপানি সৈন্য মারা যায় অপরদিকে ১২,০০০ আমেরিকান সৈন্য মারা যায় এবং ওকিনাওয়া’র ১৩০,০০০ সাধারন মানুষ এ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। জাপান এতটা বর্বর ও অমানবিক ছিলো যে কামিকাজির মত আত্মঘাতী হামলার পাশাপাশি ছোট বাচ্চাদের শরীরে বোমা লাগিয়ে আমেরিকান সামরিক যান ও স্থাপনার উপর আত্মঘাতী হামলা চালাত এবং এই আত্মঘাতী হামলার সংখ্যা ছিলো অগনিত।

টানা ৩ মাসের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ওকিনাওয়া যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং পুরো দ্বীপের দখল নেয় ঠিকই কিন্তু এ সামান্য দ্বীপ দখলে নিতে এত পরিমান মানুষের মৃত্যু হওয়ায় যুক্তরাস্ট্র অপারেশন ডাউনফল বন্ধ করে দেয়।

আর ঠিক এ সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোপন প্রজেক্টে থাকা পারমানবিক বোমার সফল টেস্ট করে আর তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জাপানকে থামাত এ পারমানবিক বোমা ব্যাবহার করবে যুক্তরাষ্ট্র।

লিটল বয় নামক পারমাণবিক বোমা

যুক্তরাষ্ট্র শেষবারের মত জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বলে কিন্তু এবার জাপান নিজেদের ইকোনমিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এবং আত্নসমাপর্ন করতে রাজি হলেও
শর্ত দেয় যে জাপান যেসব দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছে সেসব দেশকে জাপানের অংশ বলে বাকি দেশকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু আমেরিকা এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং জাপানকে তাদের সমস্ত উপনিবেশ দেশ থেকে নিজেদের সাম্রাজ্যে গুটিয়ে নেওয়া সহ আত্নসমর্পন করতে বলে কিন্তু জাপান এসব শর্ত মেনে আত্নসমর্পন করতে রাজি হয়নি।

এরপর আসে বিশ্ব ইতিহাসের সেই দিন যেদিন জাপান প্রথম পারমানবিক বোমা হামলার শিকার হয়। লিটল বয় নামে প্রথম বোমা হামলা করা হয় হিরোশিমাতে এবং ফ্যাটম্যান নামের দ্বিতীয় বোমাটি দিয়ে হামলা চালানো হয় নাগাসাকি-তে। এই হামলা চালানোর মাধ্যমে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং আত্মসমর্পণ করে অপ্রতিরোধ্য জাপান।

ছবিতে বকস্কার বোম্বার

যুক্তরাস্ট্র কি পারমানবিক বোমা হামলা না চালিয়ে অন্যকোন উপায়ে জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পারতো?

এ ব্যাপারে নানা মত থাকলেও জাপান নিজে অন্যসব উপায় বন্ধ করেছিলো। এমনকি দুই দুইবার পারমানবিক বোমা হামলার পর ও জাপানের বেশিরভাগ জেনারেল যুদ্ধ বন্ধ করার বিরুদ্ধে ছিলো।

আপনি যদি এ ব্যাপারে সাধারণ মতামত জানতে চান তাহলে অনেকেই জাপানে পারমানবিক বোমা হামলার পক্ষেই বলবে। জাপানে পারমানবিক বোমা হামলার প্রয়োজন ছিলো। মানবিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে হয়ত দেখাযাবে এটা ঠিক হয়নি কিন্তু কোনো যুদ্ধ’ই কখনো মানবিক নয় কিংবা হয়না। এটা ঠিক যে এই বোমা হামলায় ২০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো কিন্তু ওকিনাওয়া’য় মাত্র ৩ মাসের যুদ্ধে এর চেয়ে বেশি মানুষ
মৃত্যুবরণ করেছিলো। ঠিক এভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হতো।

ওকিনাওয়া দ্বীপ দখল এবং পতাকা উত্তোলন

তবে শুধুমাত্র জাপানকে আত্মসমর্পণ করানোর জন্যই কি যুক্তরাষ্ট্র পারমানবিক বোমা হামলা চালিয়েছিলো?

যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে জানান দিয়েছিলো যে সুপার পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অনেক কিছু করতে পারে। সে সময় সোভিয়েত বার্লিন দখল করার পর নিজেদের বেশি শক্তিশালী হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পায় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক বোমা হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী দেশ হিসেবে প্রকাশ করে বিশ্বের কাছে। আর এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পার্ল হারবার আক্রমনের প্রতিশোধ নেওয়া সহ বিশ্বকে বুঝিয়ে দেয় যে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার ফলাফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

Facebook Comments

comments