মধ্যযুগে বাংলা সুলতানাতের পতনের পরে যার সময়ে এই অঞ্চলের সেনাবাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলো তিনি হলেন বারো ভূইঞাদের নেতা ঈসা খান। এই মহান বীর ১৫২৯ সালে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার সরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা উত্তর প্রদেশ থেকে এসে তৎকালীন সুলতানদের দেওয়ান ছিলেন এবং তার পিতা পাঠান সুলতানদের সময়ে দেওয়ান ছিলেন। তার পিতা হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
১৫৬৪ সালে পাঠান সুলতান তাজ খানের সময়ে তাকে সোনারগাঁওতে দেওয়ানির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরবর্তী সুলতান দাউদ খানের যুগে তিনি ত্রিপুরার রাজার সাথে বাংলার কররানি পাঠান, সুলতানদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেন এবং তার নেভি চট্টগ্রাম উদ্ধারে ব্যাপক সাহায্য করে।
১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট আকবরের বাহিনীর কাছে পাঠানরা পরাজিত হয়। বিহার, বর্তমান পশ্চিম বাংলা, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ মুঘলদের দখলে গেলেও তিনি তখনকার বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের দেওয়ান ও জমিদারদের নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
১৫৭৮ সালে বাংলার মুঘল সুবেদার খান জাহান জমিদারদের থেকে বাংলা দখল করতে এলে চাদপুরের কাছে মেঘনার পাড়ে জমিদারদের হাতে তারা পরাজিত হয়।
এই পরাজয়ের পরে ১৫৮৩ সালে শাহবাজ খানের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী পাঠানো হয়। তারা ঢাকার উত্তরে বেশিরভাগ এলাকাগুলা দখলে নেয়। একবছর পর ১৫৮৪ সালে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ঈসা খান ও মাসুম খানের যৌথ নৌবাহিনী মুঘল নৌবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
অনেক উচ্চপদস্থ মুঘল সেনাপতি এই যুদ্ধে নিহত হয়। এরপরে শাহবাজ খান পিছু হটে। ১৫৮৬ সালে আকবর শাহবাজ খানের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী পাঠায়। ভাওয়াল এলাকায় ঈসা খানের এগারোসিন্ধু দুর্গের পাশেই ঈসা ও মাসুম খানের বাহিনী আবার শাহবাজ খানের বাহিনীকে পরাজিত করে।
এর মাঝখানে ঈসা খান আসাম ও কুচবিহারের সাথে বেশ কিছু যুদ্ধে জড়ান ও কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও আসামের কিছু এলাকা এবং দক্ষিণে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জয় করেন। শাহবাজ খানের পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আকবর তার অন্যতম সেরা জেনারেল মানসিংহকে নিয়োগ দেন ঈসা খানকে শায়েস্তা করতে। ঈসা খান ফরিদপুরের মুঘলদের মিত্র জমিদারদের সাথে সুসম্পর্ক গঠন করেন ও অন্যান্য এলাকার বিদ্রোহী জমিদারদের সাহায্য চান।
জমিদাররা তাদের নৌবাহিনী জড়ো করেন শীতলক্ষ্যা নদীতে। এরপর ১৫৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জমিদারদের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে মুঘল বাহিনী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে ঈসা খান ও মানসিংহের মধ্যে দ্বৈতযুদ্ধ হয় এবং মানসিংহ পরাজিত হয়। ফলস্বরূপ মানসিংহের সাথে জমিদারদের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ঈসা খানের রাজধানী ছিলো সোনারগাঁও। তার অপারেশনাল বেইস ছিলো কিশোরগঞ্জের এগারোসিন্ধু দুর্গ। এই এলাকা দিয়েই মুঘলরা জমিদারদের এলাকায় প্রবেশ করতো।
১৫৯৯ সালে এই মহান বীর মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ নেভির অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার বানৌজা ঈসা খান তার নামেই নামকরণ হয়েছে। মাত্র ৪০০ বছর আগে মুঘলদের বিরুদ্ধে এত যুদ্ধে জয়ী হওয়া এই মহান বীরকে বাঙালি জাতি ভূলে গিয়েছে। এই মহান বীরের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ সালাম ও ভালোবাসা।
©তাহসিন মাহফুজ
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.