সময়টা ১৯৬৯ জুলাইয়ের ২০ তারিখ, তখন রাত ১০:৫৬ ঠিক এমন সময়ে মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে ইতিহাস। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যায় প্রথম কোন দেশ যারা চাঁদের মাটিতে সফল ভাবে মানুষ পাঠিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছিলো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদে অবতরণকে নানা সময় নানা ধরনের কুযুক্তি দিয়ে মিথ্যা বানানোর চেষ্টা করেছে অনেক সমালোচকরা। কিন্তু কেন?

নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিনস এবং বাজ অলড্রিন

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেবল মাত্র শেষ, সবাই নিজেদের যখন গুছিয়ে নেয়ায় ব্যস্ত তখন পূর্ব-পশ্চিমের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা মিলে ৪০ দশকের শেষাংশে শুরু করে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা যা ৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর স্থায়ী ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলা এই প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতাকে বলা হয় কোল্ড ওয়ার, অনেকেই একে শীতল বা ঠান্ডা যুদ্ধ কিংবা স্নায়ুযুদ্ধও বলে থাকেন।

কোল্ড ওয়ারের সময় এ দুই দেশের মাঝে শুরু
হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে কত উন্নত অস্ত্র বানাতে পারে এই ধরনের প্রতিযোগিতা। শুধুমাত্র অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এটি সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং সামরিক ও বেসামরিক খাতেও চলে এই প্রতিযোগিতার দৌড় এবং এর সাথে যুক্ত হয় মহাকাশ গবেষণা। দুই দেশের মাঝে শুরু হয় মহাকাশ দখল করার প্রতিযোগিতা যার উদ্দেশ্য ছিলো কে কার আগে মহাকাশে যাবে এবং পরবর্তীতে এই প্রতিযোগিতার নাম দেওয়া হয় “স্পেস রেস”

অ্যাপোলো-১১ উৎক্ষেপনের সময়

স্পেস রেসের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে তাদের কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক উৎক্ষেপনের মাধ্যমে স্পেস রেসে যুক্তরাষ্ট্রেকে পেছনে ফেলে দেয় এবং ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে ইউরি গ্যাগারিনকে পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ যান লুনা-৯ চাঁদে সফট ল্যান্ডিং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো একবার পেছনে ফেলে দেয়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন লুনা-১০ মিশনের মাধ্যমে চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করে নতুন ইতিহাস তৈরি করে যা সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিলো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এভাবে একের পর এক রেকর্ড করে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

ইউরি গ্যাগারিনঃ মহাশূন্য ভ্রমণকারী প্রথম মানুষ।

কোল্ড ওয়ারের এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেছনে ফেলা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এগিয়ে যেতে হলে মহাকাশের চেয়েও দূরে কোথাও মানুষ সহ পৌঁছাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। মহাকাশে চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ আর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠাবে এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। এর পরই যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা  ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) শুরু করে মিশন “অ্যাপোলো” চাঁদে যাওয়ার জন্য এ মিশনের আন্ডারে মোট ১৭ টি মিশন পরিচালনা করা হয়।

Timeline of Apollo Missions

অ্যাপোলো মিশনের টাইমলাইন

এই মিশনের একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিলো চাঁদে সফলভাবে মানুষ পাঠানো এবং পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। তবে সে সময় এ প্রজেক্ট সফল হবে এটা কোন দেশ বিশ্বাস করেনি, যার প্রধান কারন হলো টেকনোলজি। সে সময় টেকনোলজি এতটা উন্নত ছিলোনা যে মানুষ চাঁদে যাবে আবার ফিরেও আসবে কিন্তু জল্পনা কল্পনা কাটিয়ে এ অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলো নাসা। অ্যাপোলো ১ থেকে ৭ পর্যন্ত মিশন গুলো ছিলো মনুষ্যবিহীন এবং অ্যাপোলো ৮ থেকে ১৭ পর্যন্ত মিশনগুলো ছিলো মনুষ্যবাহী। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত চাঁদে অ্যাপোলো মিশনের আন্ডারে অ্যাপোলো ১১, অ্যাপোলো ১২, অ্যাপোলো ১৪, অ্যাপোলো ১৫, অ্যাপোলো ১৬ এবং অ্যাপোলো ১৭ এ মোট ৬ বার চাঁদে মানুষ পাঠায় নাসা।

দ্যা হোয়াইট টিমঃ অ্যাপোলো ১১’র ইঞ্জিনিয়ারগণ

নিল আর্মস্ট্রং, অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্সের প্রথম মিশন পর ১৯৬৯ সালে পেট কনরাড প্রথম মানুষ যে কিনা চাঁদে রঙিন টেলিভিশন এবং ক্যামেরা নিয়ে যায়। অ্যালান শেফার্ড ১৯৭১ সালে চাঁদে গলফ খেলেছেন। একই বছর ডেভিস চাঁদে হাতুড়ি আর পালক দিয়ে গ্যালিলিওর বিখ্যাত পদার্থের ভর এবং গতিবেগের পরীক্ষা করেন। জেমস আরউইন চাঁদ থেকে মাটি এবং পাথর সংগ্রহ করে আনেন। এরপর ১৯৭২ সালে জন ইয়ং চাঁদে থাকা আমেরিকার জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করে। সবশেষে হ্যারিসন স্মিথ চাঁদে নিজের সাথে ইদুর নিয়ে যায় এবং ইদুর সহ পৃথিবীতে ফিরে আসে। কিন্তু এত ইতিহাস তৈরির পরেও কিছু মানুষ কেন মুন ল্যান্ডিং বা চাঁদে অবতরণ বিশ্বাস করেনা? আসলেই কি মুন ল্যান্ডিং হয়েছিলো? নাকি এটা শুধুই কোল্ড ওয়ারে আমেরিকার এগিয়ে থাকার একটি চাল মাত্র?

অ্যালান শেফার্ড চাঁদের পৃষ্ঠে গলফ খেলেছিলেন

মুন ল্যান্ডিং কে মিথ্যা প্রমানিত করার জন্য নানা সময় নানা মত দিয়ে এসেছে সমালোচকরা। চাঁদে কখনই কোন মানুষ যায়নি এ ব্যাপারে সমালোচকরা নানা সময় নানা দাবি নিয়ে মুন ল্যান্ডিং এর তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে। অথচ, এসব দাবির সবগুলোই ভিত্তিহীন। সমালোচকরা যেসব যুক্তি দিয়ে মুন ল্যান্ডিংকে মিথ্যা প্রমান করতে চায় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ৩টি যুক্তি নিচে দেয়া হলোঃ

চাঁদে বায়ুর কোন অস্তিত্ব নেই, তাহলে পতাকা লাগানোর পর পতাকা কিভাবে উড়ছিলো?

চাঁদে পতাকা লাগানোর পর চাঁদের অভিকর্ষের কারনে পতাকা নিচে পড়ে যাবে তাই পতাকার স্ট্যান্ডের সাথে L আকৃতির একটি দন্ড লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে পতাকা নিচে না পড়ে যায়। জড়তার কারনেই মূলত পতাকা কিছুটা উড়ছিলো এর সাথে বায়ুর কোনরকম সম্পর্ক ছিলোনা।

পতাকায় ইংরেজি অক্ষর L শেপ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ

নভোচারীদের জুতার ছাপের সাথে চাঁদের পৃষ্ঠে পায়ের ছাপের কোন মিল নেই কেন?

স্পেস স্যুটকে আরো বেশি নিরাপদ করার জন্য ডাবল লেয়ার জুতো ডিজাইন করা হয়। যার ভেতরে একটি জুতো এবং বাইরে আরো একটি জুতো থাকে এবং এর ফলেই দুটি জুতোর ছাপ ভিন্ন ভিন্ন হয়।

চাঁদের পৃষ্ঠে নীল আর্মস্ট্রং এর বুটপ্রিন্ট

 

জুতোর দুটি অংশঃ যেটির ছাপ চাঁদের পৃষ্ঠে রয়েছে সেটি মূলত জুতোর কভার যাকে ওভারবুট বা আউটার লেয়ার’ও বলা হয়।

চাঁদে তোলা ছবিতে কোন তারা দেখা যায়নি কেন?

আপনি যখন আপনার মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ছবি তুলবেন তখন ফোকাসে থাকা সাবজেক্ট বাদে ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছুই দেখা যায়না। চাঁদে উঠানো ছবির ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছে তাছাড়া এখানে শাটারস্পিড সহ আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিলো জন্য ছবিতে তারা দেখা যায়নি।

ক্যামেরা ফোকাস, শাটার স্পিড এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার জন্য ছবিতে তারা দেখা যায়নি কিন্তু মহাকাশচারী সকলেই স্পষ্ট দেখেছেন

এছাড়াও অনেক ধরনের যুক্তি দিয়ে মুন ল্যান্ডিং কে মিথ্যা প্রমান করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে অনেকে সমালোচকরা, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মুন ল্যান্ডিং যদি সাজানো হয়ে থাকে তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন  মুন ল্যান্ডিং কেন মেনে নিয়েছিল? সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের আর্টিকেলে বেশ কয়েকবার বার মুন ল্যান্ডিং কে হিস্টোরিক ইভেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কিন্তু এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে সোভিয়েত কেন আমেরিকার মত চাঁদে মানুষ পাঠানোর চেস্টা করেনি? এ নিয়ে নানা কন্সপিরেসি থিওরি রয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চাঁদে যাওয়ার আর চেস্টা না করার একমাত্র কারন হচ্ছে প্রজেক্ট কস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো মিশনে খরচ হয়েছিলো ২৫.৮ বিলিয়ন ডলার মুদ্রাস্ফীতি সহ হিসেব করলে যা এখনকার দিনে মোট খরচ দাড়াবে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের সমান যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে বহন করা সহজ ছিলোনা।

“দ্যা টাইমস” পত্রিকায় ঐতিহাসিক মুহুর্তের খবর ছাপা হয়

সে সময় অনেক আমেরিকান নাগরিকরাই এই মুন ল্যান্ডিং কে বিশ্বাস করেনি। এর প্রধান কারন হিসেবে তাদের যুক্তি ছিলো চাঁদে যাওয়ার জন্য সরকার এত পরিমান টাকা খরচ করেছে যার জন্য জনগনকে অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়েছে। আর এ জন্যই আমেরিকান নাগরিকরা মুন ল্যান্ডিং এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলো এবং একে মিথ্যা বলে একরকম সরকারের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো! বর্তমানে যেসব আমেরিকান মুন ল্যান্ডিং এ বিশ্বাস করেনা সত্যি বলতে কেন করেনা তারা নিজেরাও তা ব্যাখ্যা করতে পারেনা শুধুমাত্র কন্সপিরেসি থিওরি এবং তাদের আগের প্রজন্ম বিশ্বাস করেনি তাই তারাও মুন ল্যান্ডিং কে বিশ্বাস করেনা বলেই ব্যাপারটা এরকম হয়ে দাড়িয়েছে। সবশেষে আমরা বলতে পারি অ্যাপোলো মিশনকে সাজানো বলার কোন সুজোগ নেই। মুন ল্যান্ডিং বিশ্বের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতীয়মান থাকবে।

 

কিছু ছবিঃ

চাঁদের পৃষ্ঠে অলড্রিনের জুতো এবং ছাপ

 

নীল আর্মস্ট্রং এর জুতোর ওভারবুট যা আউটার লেয়ার নামেও পরিচিত

 

ওভারবুটের তলার ডিজাইন, যেটি থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে ছাপ পড়েছে

 

নীল আর্মস্ট্রং এর জুতোর আউটার লেয়ারের এক্স-রে; যা চাঁদের পৃষ্ঠের ছাপের সাথে স্পষ্ট

 

অ্যাপোলো-১১ মিশনের পতাকা ঝুলানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ দেখে নিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত দল

 

অ্যাপোলো-১১ মিশনের উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাগ ইন্সটলেশন প্রকৃয়া

 

অ্যাপোলো-১৭ মিশনে জন ইয়াং চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন

 

অ্যাপোলো-১৬ মিশনে ক্রুম্যান চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে চাঁদের মাটি সংগ্রহ করছেন

 

অ্যাপোলো-১১ মিশনের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিনস এবং বাজ অলড্রিন

 

অ্যাপোলো-১৪ মিশনের ক্রুম্যান

 

এপোলো ১৭ এর মডিউল যেটি ৩ জন অ্যাস্ট্রোনট এবং ৫ টি ইদুর নিয়ে চাঁদে অবতরণ করেছিলো

 

অ্যাপোলো-১১ এর কমান্ড মডিউল রিকভারির সময় তোলা হয় ছবিটি। সময়কাল ২৪ জুলাই ১৯৬৯।

 

অ্যাপোলো-১৫ মিশনের অ্যাস্ট্রোনটগণ

 

অ্যাপোলো-১৭ মিশনের অ্যাস্ট্রোনটগণ

 

ধন্যবাদান্তেঃ টিম ডিফেন্সবাংলা।

Facebook Comments

comments