সাধারনভাবে চিন্তা করলে আমরা দেখবো তাইওয়ানকে চীন নিজেদের অংশ বলে দাবি করছে কারন পূর্বে তাইওয়ানকে শাসন করেছে চীন এবং চীন আবার তাইওয়ানকে নিজেদের সাথে যুক্ত করতে চায়।

কিন্তু চীনের তাইওয়ানকে নিজেদের সাথে যুক্ত করার যে ইচ্ছা তার বাস্তবতা এরচেয়ে একদমই আলাদা।
তাইওয়ান যতটা চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকার কাছে শুধুমাত্র আমেরিকা নয় এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের প্রতিটি অঞ্চল এবং প্রতিটি দেশের কাছেই তাইওয়ান ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাইওয়ান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারে আমাদের বিস্তারিত জানতে হলে মোট ৪টি বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখতে হবেঃ

  • তাইওয়ানের ইতিহাস
  • এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরের গুরুত্ব
  • চিপ ইন্ডাস্ট্রি
  • ভবিষ্যৎ সুপারপাওয়ার এবং দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার সামরিক কর্মকাণ্ড

Aerial View of Taipei The Capital of Taiwan

তাইওয়ানের ইতিহাসঃ 

পূর্বে তাইওয়ান ছিলো দক্ষিণ চীন সাগরের একটি ছোট সামুদ্রিক দ্বীপ যা ওলন্দাজ কলোনি অংশ ছিলো। ১৬৮৩-১৮৯৫ টোটাল ২১২ বছর তাইওয়ান  শাসন করে চীন। এদিকে ১৮৯৫ সালে জাপানের কাছে চীন যুদ্ধের যায় যার ফলস্বরূপ তাইওয়ান  চলে যায় জাপান সাম্রাজ্যের অধীনে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের করুন পরিনিতির পর তাইওয়ান আবার চীনের অধীনে চলে আসে ঠিক তখন চীনের শাসক ছিলো চিয়াং কাইশেকের সরকার। সেই সময় একই সাথে মাও জেদং এর কমিউনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলো চীনা সরকার কিন্তু যুদ্ধে নিজেদের বেশিরভাগ এলাকা হারিয়ে পার্শ্ববর্তী তাইওয়ানে পালিয়ে যায় এবং তাইওয়ানের রিপাবলিক অফ চিন নামে নতুন সরকার গঠন করে চিয়াং কাইশেকের সরকার।

জাতিসংঘ সহ বেশকিছু দেশ তাইওয়ানকে সমগ্র চীনের শাসক হিসেবে মেনে নেয় এমনকি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ানই চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে চীনকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর ২০০০ সালে এসে তাইওয়ান নিজেদের আলাদা দেশ হিসেবে দাবি করে এবং আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো এ ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন করে তাইওয়ানকে।

Economic growth in Asia Pacific region

এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরের গুরুত্বঃ

এশিয়া প্যাসিফিক মহাসাগর, যা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল নামেও পরিচিত, এটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  অঞ্চল। এ মহাসাগর
পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে অবস্থিত।
এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ৬০% এরও বেশি এ অঞ্চলে বাস করে। এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগর বিশ্ব বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে এ সাগরে থাকা প্রচুর পরিমান প্রাকৃতিক সম্পদ তেল এবং গ্যাসের মজুদ থাকার জন্য এবং সবচেয়ে মজুদ রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। আর ঠিক এ জন্যই চীন এই অঞ্চলের দখল নিতে আদাজল খেয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এশিয়া প্যাসিফিক মহাসাগর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে জানান দিয়ে আসছে। এই অঞ্চলটি মালাক্কা প্রণালী, দক্ষিণ চীন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর সহ বিশ্বের কয়েকটি ব্যস্ততম বন্দর এবং শিপিং লেনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে।

এই সামুদ্রিক পথগুলো এশিয়াকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং আমেরিকার সাথে সংযুক্ত করে, যা এই জলরাশীকে বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে বিশ্বের কিছু দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ যেমন চীন, ভারত , বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং এ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান দেশ হিসেবে গন্য করা হয়।

এশিয়া প্যাসিফিক মহাসাগর বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বরাবরের মতো পরিচিত হয়ে আসছে। এই অঞ্চলটি দক্ষিণ চীন সাগর এবং কোরিয়ান উপদ্বীপ সহ বেশ কয়েকটি চলমান আঞ্চলিক বিরোধের অঞ্চল যেখানে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তর যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অপরিহার্য ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। অঞ্চলটি তেল, গ্যাস, খনিজ এবং মাছ সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের বিস্তীর্ন ভাণ্ডার। এই সম্পদ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেইসাথে এই অঞ্চলের টেকসই ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর বায়ু এবং সৌর শক্তি বা নবায়নযোগ্য শক্তির একটি অন্যতম প্রধান উৎস।

এশিয়া প্যাসিফিক মহাসাগর বিশ্ব বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি অপরিহার্য অঞ্চল। এই অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থান এবং বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ এটিকে বিশ্বের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র করে তুলেছে। অতএব, সকলের সুবিধার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিকে রক্ষা এবং টেকসইভাবে পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেইসাথে এই অঞ্চলের প্রধান একটি দ্বীপ রাস্ট্র হলো তাইওয়ান।

চিপ ইন্ডাস্ট্রিঃ

বর্তমান টেকনোলজির বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ড্রাস্টির মধ্যে
চিপ ইন্ডাস্ট্রি একটি। চিপের গুরুত্ব আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে অনুভব করছি। সামরিক এবং বেসামরিক সেক্টর সহ কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, টেলিভিশন সহ এমন কোন ইলেকট্রনিকস পন্য নেই যেখানে চিপ ব্যাবহার করা হয়না।

সারা বিশ্বে যত চিপ ব্যবহার করা হয় তার ৯২ শতাংশ সাপ্লাই করে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো এবং যেখানে তাইওয়ান একটি দ্বীপরাষ্ট্র হয়েও একাই সাপ্লাই করে ৭০ শতাংশ চিপ। যা তাইওয়ানকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটিতে রুপান্তরিত করেছে এবং সারা বিশ্বে যত চিপ নির্মাতা কোম্পানি রয়েছে তার মধ্যে তাইওয়ানের TSMC কোম্পানি সবচেয়ে মানসম্মত চিপ তৈরি করে আসছে। তাই সামরিক এবং বেসামরিক সব বিখ্যাত কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র TSMC থেকেই নিজেদের চিপ কিনে থাকে। উল্লেখ্য যে তাইওয়ানের মেগাইন্ডাষ্ট্রি TSMC একাই সারা বিশ্বের ৫৩ শতাংশ চিপের চাহিদা মেটায়।

Taiwan Semiconductor Manufacturing Company-TSMC

চিপের ব্যাবহার দিন দিন বাড়ছে। বিশ্ব যতটা টেকনোলনিজি নির্ভর হবে চিপের চাহিদা তত
বাড়বে। চিপ ইন্ডস্ট্রিতে প্রথম থেকেই নিজেদেরকে প্রমা
করে আসছে তাইওয়ান। তবে অন্যান্য সব দেশও চিপ ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো করার চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যেহেতু চিপ তৈরি খুবই জটিল প্রক্রিয়া নিয়ন গ্যাসকে লেজারে রুপান্তরিত করে লেজারের মাধ্যমে চিপের সেমিকন্ডাক্টরে সিলিকনের ক্ষুদ্র অংশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা বিলিয়নে নিয়ে গিয়ে
চিপ তৈরি করা হয় সুতরাং এত কঠিন সব ধাপ পাড়ি দিয়ে চাইলেই চিপ তৈরি করা সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে শক্তিশালী মোবাইল চিপ হিসেবে লাইম লাইটে আসা অ্যাপল এ-১৫ বায়োনিক চিপে মোট ১৫ বিলিয়ন ট্রানজিস্টর রয়েছে।

ভবিষ্যৎ সুপারপাওয়ারঃ

যদি কোন দেশ নিজেকে সুপারপাওয়ার হিসেবে দাবি করতে চায় তাহলে তার দুটো জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সারা বিশ্বের যেকোন প্রান্তে যুদ্ধ করার মত যথেষ্ট পরিমান সামরিক সক্ষমতা এবং প্রচুর পরিমানে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা। ভবিষ্যতে যদি কোন দেশ নিজেদের সুপারপাওয়ার হিসেবে দাবি করতে চায় তাহলে তার একমাত্র দাবিদার চীন কিন্তু এটা আমেরিকা কোনদিনই চাইবেনা। এইদিকে চীনকে ঠেকানোর জন্য আমেরিকা শুধুমাত্র তাইওয়ান ইস্যু নয় বরং সবধরনের ইস্যুতেই চীনকে বাধা দিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে। যেমনটা ভাবে রাশিয়াকে প্রতিহত করেছে এবং তারা সফলও হয়েছে।

আমেরিকা চাচ্ছে চীনকে দক্ষিণ চীন সাগরে আটকে রাখতে। চীন যদি দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশ করতে চায় যেভাবে তারা চাচ্ছে তাহলে প্রথমেই তাইওয়ানকে দখলে আনতে হবে। কখনও চীন যদি তাইওয়ান দখল করতে পারে তাহলে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, জাভা, বর্নিওর মতন গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ গুলোয় চীন যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারবে এবং চীন সেটাই চায়।

চীনকে চাপে রাখার জন্য আমেরিকা তাইওয়ানের সাথে চুক্তি ও করেছে যে চীন যদি কোনদিন তাইওয়ানে হামলা চালায় তাহলে আমেরিকা তাইওয়ানের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিবে। এর পাশাপাশি তাইওয়ানকে সাবমেরিন তৈরির প্রযুক্তি সরবারহ করেছে আমেরিকা। জাপান এ বছর তাদের ক্ষেপণাস্ত্র খাতে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বাজেট ঘোষণা করেছে শুধু চীনকে চাপে রাখার জন্য। আমেরিকা ফিলিপাইনে নতুন করে ৪ টি বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে যার প্রধান উদ্দেশ্য তাইওয়ানকে যেকোনো সময় এয়ার সাপোর্ট দিতে পারা।

এছাড়াও প্রায়ই জাপান, সাউথ কোরিয়া এবং আমেরিকা সংঘবদ্ধভাবে দক্ষিণ চিন সাগরে নানা ধরনের সামরিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণা এবং ধারণা অনুযায়ী ভবিষ্যতে চীন কখনই অফেন্সিভ ব্যটলে যেতে পারবেনা যেমনটা আমেরিকা ও রাশিয়া পারে। তবে মজার ব্যাপার হলো আমেরিকা নিজেও চাচ্ছে যে তাইওয়ানের সাথে চীন যুদ্ধ করুক। এর প্রধান কারন হলো চীনকে দীর্ঘকালীন একটি যুদ্ধে ফেলতে পারলে চীনের অর্থনীতির পতন শুরু হবে ঠিক যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এবং ইউক্রেনে রাশিয়াকে দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধে ফেলে বর্তমান রাশিয়ারও একই হাল করছে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে তাইওয়ান ইস্যু শুধুমাত্র চীন আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাইওয়ান আক্রমনের ফল এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরের ৩০ টি দেশ সহ সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে ভোগ করতে হবে সেটা হতে পারে পারমানবিক বোমা কিংবা অর্থনৈতিক বোমা।

Facebook Comments

comments