বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে যত হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়ে থাকে তার সিংহভাগই করা হয় এই একে-৪৭ এর সাহায্যে। পৃথিবীর ৮০ টির অধিক দেশ এই অ্যাসল্ট রাইফেল ব্যাবহার করে থাকে, যার মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

অ্যাসল্ট রাইফেলের কনসেপ্ট প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্রথম প্রবর্তন করে। তাদের সেই গবেষনার ফলাফল ছিল Sturmgewehr-44 অ্যাসল্ট রাইফেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মান সৈনিকেরা Sturmgewehr-44 রাইফেল সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাবহার করে। যা থেকে প্রাপ্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা রাশানদের প্রভাবিত করে অনুরূপ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রাইফেল তৈরির জন্য।

AK-47

Sturmgewehr-44

মিখাইল কালাশনিকভ ছিলেন একজন ওয়েপন ডিজাইনার। তিনি 7.62x39mm কার্টিজ বহনক্ষম একটি রাইফেল তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাশিয়ার আর্দ্র ও ঠান্ডা পরিবেশের জন্য উপযুক্ত সেই ধরনের একটি রাইফেল তৈরি করা ছিল সত্যিই একটি কঠিন কাজ।

অন্যদিকে এই ধরনের একটি অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরি করার জন্য রাশান আর্মিও আগ্রহ প্রকাশ করে। Alexey Sudayev সেই ধরনের একটি রাইফেল প্রদর্শন করেন ১৯৪৪ সালে। কিন্তু ওজনের দিক দিয়ে সেটা ছিল খুবই ভারী।

এরও দুই বছর পর যখন ওয়েপন ডিজাইনিং এর উপর একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তখন মিখাইল কালাশনিকভ ও তার ডিজাইনিং টিম তাদের রাইফেলের একটি নকশা প্রদর্শন করেন। এটি ছিল একটি গ্যাস অপারেটেড রাইফেল এবং এটাতে ৩০ রাউন্ড বুলেটের একটি ম্যাগাজিন ব্যবহার করা যেত। তখন এই রাইফেলকে AK-1 এবং AK-2 হিসেবে সম্বোধন করা হত।

কালাশনিকভের এই ডিজাইন প্রতিযোগীতার দ্বিতীয় ধাপের জন্য মনোনিত করা হয়। ১৯৪৬ সালে রাইফেলটি পুনরায় টেস্ট করার আগে কালাশনিকভের এক সহকারী রাইফেলটির ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর নকশা কিছুটা পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন।

AK-47

Under Barrel Grenade Launcher

কিন্তু কালাশনিকভ নকশা পরিবর্তনের জন্য অনিচ্ছুক ছিলেন কারণ তাদের রাইফেল ইতিমধ্যেই ভালো পারফর্ম করেছে অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায়। কিন্তু অবশেষে যভাবেই হোক Aleksandr Zaytsev, কালাশনিকভকে রাজি করান।

তাদের রাইফেল দ্বিতীয় রাউন্ডের ফিল্ড টেস্টে অংশগ্রহন করে এবং হালকা, নির্ভরযোগ্য, দীর্ঘ রেঞ্জ ও সহজে ব্যবহারযোগ্যতা ইত্যাদি কারণে অত্যাধুনিক অস্ত্র হিসেবে মনোনিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ একে-৪৭ এর বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেছে।

 

সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ

  • ডিজাইনার – মিখাইল কালাশনিকভ
  • প্রস্তুতকারি দেশ – রাশিয়া
  • ওজন – ৫.২১ কেজি (লোডেড ম্যাগাজিন সহ)
  • দৈর্ঘ্য – ৮৭০ মি.মি.
  • ব্যারেল – ৪১৫ মি.মি.
  • কার্টিজ – ৭.৬২×৩৯ মি.মি.
  • রেট অব ফায়ার – ৬০০ রাউন্ড/মিনিট
  • কার্যকর দূরত্ব – ৪০০ মিটার (সেমি অটোমেটিক)

একে-৪৭ বর্তমান বিশ্বের এখনও অন্যতম জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটিরও অধিক এই অস্ত্র বিক্রি হয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ৮০ টিরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে এটি ব্যবহার হচ্ছে। যা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় রাইফেল এর পরিচায়ক।

AK-47

ডুবুরির হাতে একে-৪৭

একে ৪৭ এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন এর সহজ ব্যবহার, নির্ভরতা ও রক্ষানাবেক্ষন ইত্যাদি। এটাকে বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক রাইফেল বলা হয়। ১৯৫১সাল থেকে এখনও এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সৈন্যদের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটি পানিতে ভিজিয়ে, ধুলাতে রেখে বা চরম ঠাণ্ডা পরিবেশে এটিকে আগের মতই ব্যবহার করা যায়, যা এর সমপর্যায়ের অন্যান্য অস্ত্রের ক্ষেত্রে অসম্ভব।

AK-47

7.62×39mm Bullet

একে ৪৭ এর অন্যতম বৈশিষ্ট হল এর বুলেট এর মারাত্বক ভেদন ক্ষমতা, এটি ৭.৬২×৩৯ মি.মি বুলেটকে ৭১৫ মিটার/সেকেন্ডে ছুড়ে যা ৮” কাঠ এবং ৫” কনক্রিট ভেদ করতে পারে। এছাড়া এতে কষ্টমাইজড বুলেট ব্যবহার করা যায়।

AK-47

০৩ টি ফায়ারিং মোড

এতে সিঙ্গেল শট, ব্রাস্ট অব ফায়ার এবং গ্রেনেড ছুড়ার সুবিধা আছে। নির্ভরতার দিক দিয়ে আজও একে-৪৭ অনন্য। একে-৪৭ এ কখনো ব্যাক ফায়ার হয় না। এটিকে পৃথিবীর যেকোন স্থানে ব্যবহার করা যায়। তীব্র শীত, গরম, ভেজা আবহওয়াতেই এর কিছু হয় না। অন্যান্য রাইফেলের তুলনায় একে-৪৭ জ্যাম হবার সম্ভাবনা কম। বর্তমান বিশ্বের সব দেশই একে ৪৭ বা এর বিভিন্ন সংস্করনের রাইফেল ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে একে ৪৭ এর চাইনিজ সংস্করনের লাইসেন্স ভার্সন টাইপ ৫৬ ব্যবহৃত হয়।

AK-47

বিদ্রোহীর কাঁধে একে-৪৭

একে-৪৭-এর মতো ভয়ংকর অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন কালাশনিকভ। তিনি বলেছিলেন, “আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখি এবং তারা যখন অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করে, তখন খুব কষ্ট পাই”

AK-47

মস্কোতে কালাশনিকভ ভাস্কর্য

২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মস্কোতে একে-৪৭ এর ডিজাইনার ও আবিষ্কারক মিখাইল তিমোফিয়াভিচ কালাশনিকভ ভাস্কর্য অবমুক্ত করা হয়। কালাশনিকভ এর সম্মাননায় এটি অবমুক্ত করে রাশান সেনাবাহিনী।

Facebook Comments

comments