মিলিটারী এয়ারক্রাফটগুলোতে পাইলট ও ক্রুদের জীবন রক্ষার্থে বিশেষ ধরণের সিট ব্যবহার করা হয় যা আপদকালীন সময়ে বিশেষত যখন বিমানে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না ও ধ্বংস অনিবার্য তখন ব্যবহার করে। সাধারণত সিটের নিচে রকেট মোটর বা নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্লোসিভ চার্জ ব্যবহার করে ককপিট থেকে তীব্র বেগে ক্রু সহ বের হয়ে আসে ও প্যারাস্যুট খুলে নিরাপদে মাটিতে অবতরণ করে।

১৯১০ সালে বাঞ্জি এসিস্টেড সিস্টেমে আক্রান্ত বিমান থেকে পাইলট বের হয়ে আসতো। ১৯১৬ সালে যখন এভার্ড ক্যালথর্প প্যারাস্যুট আবিষ্কার করেন ও পেটেন্ট নেন তখন বিমান থেকে সিট ইজেক্ট অনেক সহজ ও নিরাপদ হয়ে যায়। বর্তমানে আমরা যে আধুনিক সিট ইজেক্টর দেখি যা রোমানিয়ান আবিষ্কারক আনাস্টেস ড্রগোমির উদ্বাভণ করেন যেখানে সিটের নিচে কমপ্রেসড এয়ার ব্যবহার করা হয়। পাইলট সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর একটি কর্ড টেনে দিলে সিটের নিচে এয়ার সিলিণ্ডার তীব্র বেগে নিয়ন্ত্রিত ভাবে বাতাস ছেড়ে দেয় নিচের দিকে ও পাইলট সিটসহ ককপিট থেকে বের হয়ে আসে।

১৯২৯ সালে প্যারিসে সফলভাবে এই পদ্ধতিতে পাইলট সিট ইজেক্ট করে নিরাপদে ভূমিতে অবতরণ করেন। ড্রগোমির প্যারিসে প্যাটেন্ট নেন।

২য় বিশ্বযুদ্ধে এই সিট ইজেক্টর সফল ভাবে ব্যবহার করা হয় যদিও এতে অনেক খুঁত থাকে। যেমন তখন সিট ইজেক্ট বলতে প্লেনের ককপিট থেকে কয়েক ফুট দূরে ছিটকে পড়াই বোঝাতো। আক্রান্ত বিমানের ক্রু যদি আহত হতো তাহলে আর বের হতে পারতো না। তাছাড়া তখন ব্রিদিং সিস্টেম উন্নর ছিলো না তাই ককপিট থেকে বের হলে শ্বাসকষ্টে পাইলট মারা যেত। বিমানের অলটিচ্যুড কম থাকলে প্যারাস্যুট সম্পূর্ণ খোলার আগেই মাটিতে আছড়ে পরে মারা যেত। তাছাড়া কয়েক’শ কিলোমিটার স্পীডে চলা বিমান থেকে বের হলে ‘জি ফোর্সে’র কারণেও আহত বা নিহত হতো। তবুও অন্যান্য সময়ের তুলনায় লাইফ সেভিং সিস্টেম ছিলো।

জার্মানীর হেইঙ্কেল ও সুইডেনের স্যাব বিমান কোম্পানী আলাদা আলাদা সিট ইজেক্টর ডেভেলপ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধে।

Heinkel He 280 জেট বিমানে প্রথম কম্রেসড এয়ারের সিট ইজেক্টর ফিট করে। টেস্ট পাইলট হেলমুট শ্যাঙ্ক ১৯৪২ সালে প্রথম হেইঙ্কেল এইচই ২৮০ বিমান থেকে সফল ভাবে ইজেক্ট হন যখন তার প্লেনের নিয়ন্ত্রণ হারান ভূমি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উচ্চতায়। স্যাব ২১ বিমানে প্রথমে কম্প্রেসড্ এয়ার ও পরে গানপাউডার ইউজ করে ইজেশনের জন্য। ১৯৪৪ সালে সফলভাবে ইজেক্ট করা হয় ও ১৯৪৬ সালে লেফটেন্যান্ট বেঙ্গট জোহানসন তার জে ২১ ও অপর জে ২২ বিমানের মাঝ আকাশে সংঘর্ষ হলে সফলভাবে ইজেক্ট করেন।

বিমানে গতি বৃদ্ধিত সাথে সাথে ইজেক্টর সিটও কমপ্লেক্স হয়। সুপারসনিক স্পীডের বিমান থেকে বের হতে হলে রকেট পাওয়ার্ড ইজেক্টর লাগে। নইলে বিমানের টেইল বা স্পিনিং এর সময় ডানায় পাইলটের দেহের ধাক্কা লেগে পাইলট থেতলে যাবেন।

ষাটের দশকে ক্যানবেরা বম্বার থেকে সাতান্ন হাজার ফিট উচ্চতা বা সাড়ে সতেরো কিলোমিটার উচু থেকে সফল ভাবে সিট ইজেক্ট করেন। বলাবাহুল্য তখন ব্রিদিং সিস্টেম উন্নয় হয় বিধায় হাই অলটিচ্যুডে অক্সিজেনের অভাব হয় নি। ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় ডি-২১ ড্রোন ও লকহীড এম-২১ থেকে ভূমি থেকে আশি হাজার ফিট বা ২৪ কিলোমিটার উচ্চতায় ও ম্যাক ৩.২৫ স্পীডে সফলভাবে সিট ইজেক্ট করে।

বর্তমানে বিমানে ইগ্রেস ইজেক্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হয়; যা প্রথমে ক্যানোপি বা পাইলটের মাথার উপরের ছাঁদ জেটিসন সিস্টেমে উড়িয়ে দেয় ও পরে সিট বের করে। দুই ইজেকশনের মাঝে সময়ের ব্যবধান সীমিত।

বর্তমানে কিছু হেলিকপ্টারেও ইজেক্ট সিস্টেম ব্যবহার করে। যেমন রাশিয়ান কামোভ কেএ ৫২। সাধারণত পাইলট আপদকালীন সময়ে ইজেক্ট বাটন চাপলে রোটরের এক্সেল থেকে ব্লেড গুলো বিচ্ছিন্ন হয় ও কেন্দ্রবিমুখি বলের কারণে চারদিকে ছিটকে যায় এবং জেট ফাইটারের মতই ইজেকশন হয়। এই সিস্টেম হয় এটাক হেলিকপ্টারের। তাছাড়া ইজেকশনের সময় রোটর এমন ভাবে জ্যাম করে যেন ব্লেড ককপিটের উপর না থেকে পাশে থাকে। একই ভাবে কিছু ছোট বেসামরিক কপ্টারও ব্লেড বিচ্ছিন্ন না করে জ্যামিং এর মাধ্যমে স্থির করে ও ইজেকশন উপরে না হয়ে পাশে হয়। ধনকুবের ব্যবসায়ীরা নিজেদের পার্সোনাল কপ্টারে এই সিস্টেম রাখে।

জিরো জিরো ইজেকশন সিট নামক আরেক সিস্টেম আছে যা রানওয়েতে স্থির বিমান থেকে ইজেক্ট হতে সাহায্য করে। এখানে ভূমি থেকে উচ্চতা বা অলটিচ্যুড শূণ্য (জিরো) এবং বিমানের গতিও শূণ্য (জিরো) তাই পাইলটের প্যারাসুট খুব কম বাতাস ও উচ্চতা পায় খুলতে। এই সমস্যা কাটানোর জন্য ইজেকশন সিটে শক্তিশালী ক্যানন পাওয়ার্ড রকেট ও প্যারাস্যূটের কাছে ছোট এক্সপ্লোশন রাখে যেন ভূমি থেকে কম সময়ে অধিক উচ্চতায় যাওয়া যায় ও কম সময়ে প্যারাস্যূট সম্পূর্ণ খুলে যায়। নয়তো মাটিতে পাইলট আছড়ে পড়বে।

জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি বা বিমান গেলে কেনা যাবে কিন্তু প্রাণ আর ফেরানো যাবে না এই ধরণের ‘মানবিক‘ কারণেই যে সিট ইজেক্টর ব্যবহার করে তা নয়। একজন সিভিলিয়ানকে সুদক্ষ পাইলট হিসেবে তৈরী করতে বিমানবাহিনী বা সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়। একই সাথে একজন দক্ষ পাইলট যেকোন এয়ারফোর্সের কাছে মূল্যবান। শুধু যে টাকা তা নয় কারণ এখানে সময় একটা বড় ফ্যাক্ট। পয়সা খরচ করলেই বিমান কেনা যায় কিন্তু মিলিয়ন ডলার ঢাললেও একজন দক্ষ পাইলট তৈরী করা যায় না। একই ব্যাপার শিল্পপতিদের জন্যও। তাই সিট ইজেক্ট প্রয়োজন।


লেখায়ঃ নাজমুস সাকিব ও এডমিন কর্তৃক সংযোজিত।

Facebook Comments

comments