সাল ১৯৪১, চেকোশ্লোভাকিয়ায় তিন বছর ধরে চলছে জার্মান নাৎসী শাসন। এর নাম তখন প্রোটেক্টরেট অব বোহেমিয়া এন্ড মোরাভিয়া। ডেপুটি গভর্নর হিসেবে আছেন রেইনহার্ড হাইড্রিক ওয়াফেন এসএস-এর শীর্ষ অফিসার। নির্বিকার চিত্তে মানুষ মারার বেলায় তার খুব খ্যাতি। এজন্য হিটলারের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। নিষ্ঠুরতায় হাইড্রিক ছিলেন সিদ্ধহস্ত, এমনকি হিটলার তাকে ডাকতেন দ্য ম্যান উইথ আয়রন হার্ট নামে!

Adolf Hitler & Reinhard Heydrich

Adolf Hitler & Reinhard Heydrich

রেইনহার্ড হাইড্রিক দায়িত্ব গ্রহণের ছয়মাস পূর্ণ না হতেই অধিকৃত চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগের মানুষের কাছে দ্য বুচার অফ প্রাগ অথবা প্রাগের কসাই নামে পরিচিতি পান। এর কারণ ছিল, তিনি প্রাগসহ সম্পূর্ণ চেকোশ্লোভাকিয়ায় প্রচুর নিষ্ঠুরতা চালান যার ফলে অধিকৃত প্রাগে মানুষের দিনযাপন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ!

চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রবাসী সরকার তখন লন্ডনে৷ এমন পরিস্থিতিতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, জার্মানদেরকে একটা বড়সড় ধাক্কা দিতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় হিটলারের কাছের মানুষ ডেপুটি গভর্নর রেইনহার্ড হাইড্রিককে হত্যার জন্য গোপন মিশন বাস্তবায়নের। ব্রিটিশ স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (SOE) এর তত্ত্বাবধানে খুব গোপনীয়তার সাথে ২৪ জন চেক সৈন্যকে নিয়ে শুরু হয় ট্রেনিং। শেষাবধি দুজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় এবং ১৯৪১ এর অক্টোবরেই মিশন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিন্তু হঠাৎ তাদের একজন মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে ছিটকে পড়ে এবং অপারেশন পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে আরেকজনকে নেওয়া হয়।

Rainhard Heydrich

শেষপর্যন্ত সবকিছু চূড়ান্ত হয় ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে। মিশনের নাম দেওয়া হয় “অপারেশন এনথ্রোপয়েড”। মিশনের দায়িত্বে দুজন – ওয়ারেন্ট অফিসার জোসেফ গ্যাবচিকজ্যান কুবিস যিনি ছিলেন স্টাফ সার্জেন্ট। তাদেরকে ব্রিটিশ বিমানে করে একরাতে প্যারাশুট দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় জার্মান অধিকৃত চেকোশ্লোভাকিয়ায়। সেখানে পরিচিত বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকতে শুরু করেন তারা, পাশাপাশি নিতে থাকেন মিশন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি।

তবে তারা হাইড্রিককে বাগে পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। শেষপর্যন্ত সুযোগ আসে ১৯৪২ সালের ২৭ মে। হাইড্রিক সেদিন তার মার্সিডিজ এম-৩২০ ছাদখোলা গাড়িতে করে বাসা থেকে প্রাগ ক্যাসেলে তার অফিসে যাচ্ছিলেন। পথের এক জায়গায়, যেখানে তীব্র বাঁকের কারণে গাড়ির গতি কমাতে হয়, সেখানটায় স্টেনগানএন্টি ট্যাংক গ্রেনেড নিয়ে অবস্থান নেন গ্যাবচিক ও কুবিস। তাদের সহায়তায় সাথে ছিলেন ভালসিক নামে আরেকজন চেক সৈন্য।

হাইড্রিকের গাড়ি মোড়টার সামনে এলে ভালসিক তাদের দুজনকে ইশারা করেন। সাথে সাথে গ্যাবচিক তার রেইনকোটের নিচ থেকে স্টেনগানটা বের করেন, গাড়ির সামনে লাফিয়ে দাঁড়ান এবং হাইড্রিককে লক্ষ্য করে ট্রিগার চাপেন কিন্তু ফলাফল শূন্য! বন্দুকের নল দিয়ে একটা গুলিও বের হলো না কারন তার স্টেনগান জ্যাম হয়ে গিয়েছে!

Mercedes M-320

ওদিকে ততক্ষণে হাইড্রিক বুঝে ফেলেছেন যে গ্যাবচিক তাকেই মারতে এসেছেন। তিনি হোলস্টার থেকে লুগার পিস্তল বের করেন, গ্যাবচিক নিজেও তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঠিক তখনই অন্যপাশে থাকা দ্বিতীয় ঘাতক, স্টাফ সার্জেন্ট কুবিস হাইড্রিকের গাড়িটাকে লক্ষ্য করে একটি ব্রিটিশ নাম্বার-৭৩ এন্টি ট্যাংক গ্রেনেড ছোঁড়েন। তাড়াহুড়োয় গ্রেনেডটিও ঠিকঠাক পড়েনি, গ্রেনেডটি গিয়ে পড়ে গাড়ির পেছনের চাকার নিচে! বিশাল এক বিস্ফোরণ, গাড়িটির একপাশ শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। অনেকগুলো শার্পনেল আঘাত করে হাইড্রিকের শরীরের বাঁ-পাশে। রক্তাক্ত অবস্থায়ও তিনি পিস্তল নিয়ে ছোটেন গ্যাবচিককে মারতে।

গ্যাবচিক ততক্ষণে পালিয়েছেন। এদিকে কুবিসও মিশে যান জনসাধারণের মধ্যে। একটু পরই আহত হাইড্রিক লুটিয়ে পড়েন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। জার্মানি থেকে শীর্ষ ডাক্তারদের পাঠানো হয় প্রাগে হাইড্রিকের উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন রেইনহার্ড হাইড্রিক। অপারেশন এনথ্রোপয়েডের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়।

From left - Jan Kubis and Jozef Gabcik

From left – Jan Kubis and Jozef Gabcik

কিন্তু সেই গুপ্ত হামলাকারী দুই সেনা? তারাও বাঁচেননি বেশিদিন! অপারেশনের পর বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ছিলেন তারা। তাদের সন্ধানে দশলাখ রাইখসমার্ক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। অন্য একজন চেক সৈন্য টাকার লোভে জার্মানদেরকে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেন। ২৫ অক্টোবর ১৯৪২, গ্যাবচিক ও কুবিস যে অর্থোডক্স চার্চে অবস্থান করছিলেন সেখানে এসএস-এর ৭৫০ জন সৈন্য চিরুনি অভিযান চালালেও সেইদিন সেই দুই হামলাকারীকে তারা জীবিত ধরতে ব্যর্থ হয়। কুবিস নিহত হন বন্দুকযুদ্ধে   গ্যাবচিক বেছে নেন আত্মহত্যা! অন্যদিকে জার্মান কর্তৃপক্ষ এত গুরুত্বপূর্ণ একজন অফিসারকে হারিয়ে প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে যায়। তারা প্রাগ ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক বর্বরতা চালিয়ে আরো কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

Jan Kubis & Jozef Gabcik

অপারেশন এনথ্রোপয়েড ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া একমাত্র গুপ্তহত্যা অভিযান। পরবর্তীতে একবার স্বয়ং হিটলারকে হত্যার চিন্তাভাবনা করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই এটিই হয়ে আছে যুদ্ধের একমাত্র গুপ্তহত্যার অপারেশন।

চেকোশ্লোভাকিয়া, তথা বর্তমানের চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়ার মানুষ আজও গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে সেই দুই সাহসী বীর গ্যাবচিক ও কুবিসকে৷ তারা দেশের মানুষের কাছে মহানায়ক হয়ে রয়েছেন বছরের পর বছর ধরে।

 

 

Facebook Comments

comments