সাল ১৯৬৭, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ! যেটি সিক্স ডে ওয়ার বা ছয়দিনের যুদ্ধ নামেই অধিক পরিচিত। এই যুদ্ধে ইসরায়েল আকস্মিক ও তীব্র আক্রমণ চালিয়ে মিশরের কাছ থেকে সুয়েজ খালের পূর্বদিকের বিশাল সিনাই উপত্যকা এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান হাইটস দখল করে নেয়। তারপর থেকেই অঞ্চল দুটি ছিল ইসরায়েলের দখলে। সিনাই উপত্যকা মূলত মিশরের সুয়েজ খালের পূর্বপাড়ের অংশ। অর্থাৎ সুয়েজ খাল (এবং লোহিত সাগর) এর মাধ্যমে এই উপত্যকাটি মিশরের বাকি অংশ থেকে ছিলো বিচ্ছিন্ন। এই উপত্যকাটিই ইসরায়েল দখলে নেয়, যার আয়তন প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মতো!
সিনাই উপত্যকা দখলের পরপরই ইসরায়েল মিশরের দিক থেকে হামলা ঠেকাতে সুয়েজ খালের পাড়ে তৈরি করে দীর্ঘ এক ডিফেন্স বেল্ট, যার নাম তাদের সাবেক সেনাপ্রধানের নামানুসারে রাখা হয় বারলেভ লাইন। এর প্রধান অংশ ছিল মোটা শক্তিশালী বালির বাঁধ এবং তার পেছনে ট্রেঞ্চ পজিশন, যা একে ট্যাংক চলাচলের অনুপযোগী করে তুলেছিল। এজন্যই ইসরায়েল দম্ভভরে বলতো যে এটিই ছিল তৎকালীন পৃথিবীতে সবচেয়ে সুরক্ষিত ডিফেন্স লাইন এবং একে ধসাতে হলে অন্তত ৪৮ ঘন্টা সময় লাগবে! আর ততক্ষণে বাঁধের পেছনে ইসরায়েলের মূল বাহিনী মিশরকে মোকাবিলার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে পারবে।
মিশর ‘৬৭-র যুদ্ধে সিনাই হারানোর পর থেকেই গোপনে পরিকল্পনা করতে থাকে সেটি পুনরুদ্ধারের। এজন্য তারা ১৯৬৮ সাল থেকেই অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা ছিল দুর্ভেদ্য বারলেভ লাইন। এটি অতিক্রম করা আসলেই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এমন সময় এগিয়ে আসেন মিশরীয় সেনাবাহিনীর এক তরুণ খ্রিস্টান অফিসার নাম বাকি জাকি ইয়োসেফ, ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ইয়োসেফ মতপ্রকাশ করেন যে, বারলেভ লাইনের বালির বাঁধকে ধসানোর জন্য ওয়াটার ক্যানন, অর্থাৎ শক্তিশালী পাম্প ও হোস-পাইপ ব্যবহার করে বাঁধের ওপর তীব্রবেগে পানির প্রবাহ নিক্ষেপ করা যেতে পারে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে বালির বাঁধটা ধসে পড়বে এবং মিশরের ট্যাংক ও সেনাবহর সিনাইয়ের মূল অংশে প্রবেশ করতে পারবে।
ইয়োসেফের পরিকল্পনা মোতাবেক মিশর প্রায় ৫০০টি পাম্প ও হোস-পাইপ সংগ্রহ করে। ব্যাপক গোপনীয়তার সাথে অন্য সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়। সিনাইয়ে ইসরায়েলি অবস্থানে আক্রমণের তারিখ ঠিক করা হয় ৬ অক্টোবর ১৯৭৩। সেদিন ছিল ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব ইয়ম কিপুরের দিন, সরকারি ছুটি। এ কারণে ইসরায়েলের প্রহরা কিছুটা হলেও দুর্বল থাকবে, এই ভেবে দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়। একইসাথে তখন চলছিল পবিত্র রমজান মাসও। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর (বদর যুদ্ধ্ব রমজান মাসেই হয়েছিল) এর নামানুসারে অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন বদর। আরবিতে বদর শব্দের অর্থ পূর্ণিমার চাঁদ।
০৬ অক্টোবর ১৯৭৩, বেলা ২টায় শুরু হয় অপারেশন বদর। একইসাথে বিমান, আর্টিলারি ও ইনফেন্ট্রি – তিনটি দিয়েই হামলা শুরু করে মিশর। হামলায় অংশ নেয় মিগ-২১, মিগ-১৭ ও সুখোই-৭ সিরিজের দুই শতাধিক মিশরীয় যুদ্ধবিমান এবং খালের এপাড়ে অবস্থিত কয়েকশ’ আর্টিলারি গান! আর্টিলারি গান থেকে ফায়ার করা হাজার হাজার শেল গিয়ে পড়তে থাকে বারলেভ লাইনের ইসরায়েলি অবস্থানগুলোতে। আক্রমণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিলো যে, আর্টিলারি গানগুলো অপারেশন বদরের শুরুর মাত্র ৫৩ মিনিটেই বারলেভ লাইনকে লক্ষ্য করে ১০ হাজার ৫০০ শেল নিক্ষেপ করে, অর্থাৎ গড়ে প্রতি মিনিটে ১৯৮টি শেল ফায়ার করে। আকস্মিক এই শক্তিশালী হামলায় ইসরায়েল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
বিমান ও আর্টিলারি হামলার মধ্যেই মিশরের ইনফ্যান্ট্রি ও আর্মার্ড (ট্যাংক) বাহিনী সুয়েজ খাল পাড়ি দিতে শুরু করে। সাথে সেই শ’পাঁচেক পাম্প ও হোস-পাইপ। পন্টুন ব্রিজ তৈরি করে মিশরের ইনফেন্ট্রি বাহিনী ও ট্যাংকগুলো খাল পার হয় এবং হোস-পাইপগুলো দিয়ে বারলেভ লাইনের বালির বাঁধের ওপর তীব্রবেগে পানি নিক্ষেপ করতে থাকে। ঘন্টাখানেক পরই বারলেভ লাইন ভাঙতে শুরু করে এবং তিনঘন্টার কম সময়ের মধ্যেই বাঁধটি গলে গিয়ে মিশরের সৈন্যদের জন্য সিনাইয়ে প্রবেশের পথ একেবারে উন্মুক্ত করে দেয়। পাঁচটি ভাগে ভাগ হয়ে মিশরের ৩২ হাজার ইনফেন্ট্রি সৈন্য ও প্রায় ১৩০০ ট্যাংক সুয়েজ খাল অতিক্রম করে এবং বারলেভ লাইন পেরিয়ে সিনাইয়ে ঢুকে ইসরায়েলি অবস্থানে আক্রমণ করতে শুরু করে। শুরু হয়ে যায় চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যেটি পরবর্তীতে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়।
মাত্র ছয়ঘন্টার মধ্যেই মিশর ইসরায়েলের কাছ থেকে অন্তত ১৫টি শক্তিশালী পয়েন্ট দখল করে নেয়। কয়েক কিলোমিটার গভীরে প্রবেশের পর পরেরদিন ৭ অক্টোবর তারা ইসরায়েলের ট্যাংক ও ইনফেন্ট্রি বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। কিন্তু মিশর সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। তাদের সাথে ছিল প্রচুর সোভিয়েত এটি-৩ স্যাগার এন্টিট্যাংক মিসাইল এবং আরপিজি এন্টিট্যাংক গ্রেনেড।
মিশরের এন্টি-ট্যাংক মিসাইল ও গ্রেনেডগুলোর হামলায় ইসরায়েল দুদিনের মধ্যে ৪০০টি ট্যাংক হারায়। বিপরীতে মিশর হারায় মাত্র ২০টি ট্যাংক। অক্টোবর ০৮, সিনাই উপত্যকার পশ্চিমদিকের এক বিশাল অংশ মিশরের কবজায় চলে আসে৷ ততদিনে সেখানে প্রায় একলাখ মিশরীয় সৈন্যের সমাবেশ ঘটেছে। অপারেশন বদর তার শেষপ্রান্তে পৌঁছায়। অপারেশন শেষে সিনাই উপত্যকার প্রায় ১৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত ও ১৫ কিলোমিটার গভীর অংশ দখল করে ব্রিজহেড স্থাপনে সক্ষম হয় মিশর। অপারেশন বদরে ইসরায়েলি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক বেশি। প্রায় এক হাজার ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ২ হাজারের বেশি আহত হয়। মিশরের নিহতের সংখ্যা ছিল ২৮০।
যদিও শেষপর্যন্ত এই যুদ্ধে মিশর পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের শুরুর অভিযান অপারেশন বদর ছিল শতভাগ সফল একটি অপারেশন। এক তরুণ অফিসারের মাথা থেকে বেরোনো অসাধারণ এক আইডিয়ায় কয়েক ঘন্টায়ই চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ইসরায়েলের অহংকার বারলেভ লাইন! যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই জনপ্রিয় প্রবাদটাকেই, অহংকার পতনের মূল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.