৯ ই আগস্ট, ১৯৭১

টাঙাইলের ধলেশ্বরী নদীর তীরে পাকিস্তানী বাহিনীর ৭ টি জাহাজ এসে নোঙর করলো। এর মাঝে ২ টা বিশাল বড় জাহাজ ত্রিপল দিয়ে মুড়ে রাখা। প্রথমে ধারনা করা হয়েছিল পাকবাহিনী আশেপাশে কোথাও হামলা চালাবে। কিন্ত জাহাজে পাকসেনার সংখ্যা জাহাজের আকারের তুলনায় অনেক কম। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার মেজর হাবিব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নিজেই মাছধরা জেলের ছদ্মবেশে খবর সংগ্রহ করলেন। আরও গোয়েন্দা লাগানো হল। জানা গেল, অস্ত্রবোঝাই জাহাজগুলো বগুরার ফুলছরি ঘাটে খালাস করা হবে। তারপর রংপুর আর সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এ অস্ত্র পাঠানো হবে।

ক্ষুধার্ত মানুষের লোভ থাকে খাবারের দিকে, তেমনি মুক্তিফৌজের সেনাদের লোভ ছিল অস্ত্রের প্রতি। কারন তাদের কাছে অস্ত্রের মারাত্মক সংকট চলছিল। অনেক সময় দরকার হলেও গুলি চালানো যেত না, প্রত্যেক সেনার হাতে রাইফেলও ছিল না। ক্ষুধার্ত বাঘ হরিনকে সামনে পেলে তার যে দশা হয় মুক্তিযোদ্ধাদেরও অনেকটা সেরকম ক্ষুধা, তবে সেটা অস্ত্রের জন্য।

Operation JahajMara

অস্ত্রসংকটে মুক্তিবাহিনীর একাংশ

মেজর হাবীব সিদ্ধান্ত নিলেন-যে করেই হোক পাকবাহিনীর অস্ত্র হস্তগত করতে হবে। কারন, যেটুকু সামান্য বারুদ আছে তা দিয়ে বেশীদিন লড়াই চালানো যাবে না।

আর অস্ত্র ছাড়া লড়াই চলবে কিভাবে???

কিন্ত সামান্য অস্ত্র নিয়ে কিছু মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে পাকবাহিনীর সাত সাতটা জাহাজ দখল করা অসম্ভব। জরুরি সেনা পাঠানোর অনুরোধ করে সিগন্যাল পাঠানো হল। কিন্ত এক বিচিত্র উত্তর এলো। বলা হল-প্লান করে সুবিধামত আঘাত করো, জাহাজ দখলে আসবে। মেজর হাবীব এই উত্তরে বেশ অবাক হলেন।

সাতটা জাহাজে সামান্য কিছু সেনার মাধ্যমে আঘাত হানতে হবে !!!

Operation Jahaj Mara

মেজর হাবীব

মেজর হাবীব দমে যাবার পাত্র নন। তিনি পরিকল্পনা সাজালেন। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর তীরে সুবিধামত পজিশন নিল। মেজর হাবীবের আগে যেন কেউ গুলি না চালায় সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হল।মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ও সেনা দুইটাই কম। মেপে মেপে গুলি খরচ করতে হবে। আর পাকবাহিনীর কাছে প্রচুর অস্ত্র।

১১ ই আগস্ট সকালের দিকে সার বেধে পাকিস্তানী জাহাজগুলো মুক্তিফৌজের দিকে এগিয়ে এলো। পানির গভীরতা বেশী থাকায় জাহাজগুলো কাছ দিয়েই যাচ্ছিল। রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে সেনারা প্রস্তুত। নিশ্বাস বন্ধ করে সবাই মেজর হাবীবের ফায়ারিং শুরু করার অপেক্ষা করছেন। একে একে দুইটি জাহাজ মুক্তিফৌজকে অতিক্রম করে গেল। মেজর হাবীব কিছু করলেন না। অধীর আগ্রহে বসে থাকা যোদ্ধারা আরও অধৈয্য হয়ে উঠল যখন দেখল ৩য় জাহাজটি তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। দক্ষ সেনাপতি মেজর হাবীবের উপর সবার আস্থা আছে। কিন্ত পাকবাহিনীর অস্ত্রবোঝাই জাহাজবহর তাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে। অথচ মেজর হাবীব এখনো অপেক্ষা করছেন। মুক্তিফৌজ চঞ্চল হয়ে উঠলো।

কেন মেজর হাবীব গুলি করছেন না??!

Operation JahajMara

মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন

ত্রিপলে ঢাকা বিশাল জাহাজ দুটি কাছাকাছি চলে এল। জাহাজের দুই পাশে হেভি মেশিনগান নিয়ে মিলিটারি বসে আছে। কিন্ত মেজর হাবীব এখনো অপেক্ষা করছেন। একসময় অপেক্ষার প্রহর শেষ হল। রেঞ্জের ভেতরে আসা মাত্র মেজর হাবীবের লাইট মেশিনগান থেকে ঝাকে ঝাকে গুলি মেশিনগান অপারেটর পাকসেনার দিকে ছুটে গেল। একই সাথে মুক্তিফৌজের সশস্ত্র যোদ্ধাদের অস্ত্রও আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে গুলি করতে লাগল।

Operation JahajMara

মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন

২ ইঞ্চি মর্টার শেলগুলো পাকবাহিনীর জাহাজের কামরাগুলোর দিকে নিক্ষেপিত হতে থাকলো। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা অবাক হয়ে দেখল জাহাজ দুটি যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই অগভীর পানিতে গিয়ে ডুবোচরের উপর আটকে গেল। একইসময় পাকবাহিনীর বাকি ৫ টি জাহাজ আক্রান্ত জাহাজ দুটির সাহায্যে না এসে বরং পালিয়ে গেলো। একটু পর আক্রান্ত জাহাজের জীবিত পাকসেনারা জাহাজ থেকে কিছু স্পিডবোট নামিয়ে তাতে চড়ে পড়িমড়ি করে ছুটে পালাল এবং জাহাজের বাংগালী নাবিকরা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে তীরে এল। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারলো পাকবাহিনীর এসিস্ট্যান্ট কমান্ডার সহ প্রায় দুই ডজন পাকসেনা মারা গেছে আর বাকিরা বোটে করে পালিয়েছে। জাহাজ এখন খালি। জাহাজ দখলের ক্রেডিট মুলত পাকিস্তানী বাহিনীর জাহাজের বাংলাদেশী সারেং মোহাম্মদ গোলাম মোস্তোফার। তিনিই বাহিনীর ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য বংগবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকির কাছে পাঠিয়েছিলেন আর জানিয়ে দিয়েছিলেন হামলা করলেই তিনি জাহাজ চরে আটকে দেবেন।আর তাই মেজর হাবীব গুলি করা মাত্রই তিনি জাহাজকে চড়ে আটকে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

তবে মেজর হাবীবের হাতে সময় বেশী নেই। সারেং জানাল পাকবাহিনী সাহায্যের জন্য তাদের ঘাটিতে সিগন্যাল পাঠিয়েছে। দ্রুত অস্ত্র খালাস করতে হবে। এই পরাজয়ের পর ক্ষিপ্ত পাকবাহিনী শোধ নিতে পালটা হামলা চালাতে আসবে তা এককোটি ভাগ নিশ্চিত। আর যুদ্ধে মুক্তিফৌজ এর অনেক অস্ত্র খরচ হয়েছে। পাকবাহিনীর পাল্টা হামলার আগে জাহাহজের অস্ত্র বাগে আনতে না পারলে পুরো খাটুনি জলে যাবে। আর কয়েকঘন্টা যুদ্ধ করার মত অস্ত্রও হাতে নেই। তাই দ্রুত মাল খালাস করা দরকার। কিন্ত হাতে লোকজন কম।

দ্রত কিছু ডিঙি নৌকা ও ভেলা জোগাড় করা হল।ডেকে আনা হল গ্রামবাসীদের। প্রায় পাঁচশো লোক নাওয়া খাওয়া ছেড়ে একটানা ছয় ঘন্টা কাজ করে দুই জাহাজের অর্ধেক অস্ত্রও নামাতে পারলেন না। কিন্ত যেটুকু নামানো হয়েছিল তা শুনলেই আপনার চোখ কপালে উঠে যাবে।

 

নামানো হয়েছিলঃ

১) চাইনিজ ৩ ইঞ্চি মর্টার সেল: এক লক্ষ বিশ হাজার।
২) চাইনিজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার সেল: দশ হাজার।
৩) ব্রিটিশ ২ ইঞ্চি মর্টার সেল: চল্লিশ হাজার।
৪) ৮২ ব্লান্ডার সাইট সেল: ষাট হাজার।
৫) ৭২ আরআর সেল: বারো হাজার।
৬) ৬ পাউন্ড সেল: সাত হাজার।
৭) ১২০ এমএম সেল: পাঁচ হাজার বাক্স।
৮) চাইনিজ রাইফেল: পাঁচশটি।
৯) ৩০৩ রাইফেল: একশটি।
১০) ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড: সত্তর হাজার।
১১) স্মোক গ্রেনেড: দশ হাজার।
১২) চাইনিজ এমজি: দুটি।
১৩) চাইনিজ ৭.৬২ গুলি: দশ লক্ষ।
১৪) চাইনিজ ৭.৬৫ গুলি: দুই লক্ষ।
১৫) ৩০৩ গুলি : এক লক্ষ।
১৬) চাইনিজ এমজি গুলি: পাঁচ হাজার

রাত ১০ টার পর জাহাজ পরিত্যাগ করে ডিজেল ঢেলে ব্যাটারির সাহায্যে আগুন ধরানো হয়। এই আগুন কয়েকদিন ধরে জ্বলেছিল আর ৩০ কি.মি. দূরে থেকে পাকবাহিনীর ঘাটি থেকেও দেখা গিয়েছিল।

Operation JahajMara

লুন্ঠিত অস্ত্রগুলো দিয়ে পুরো বাহিনী দ্রুত সুসজ্জিত হয়ে পাল্টা হামলার জবাব দিতে প্রস্তুত হয় আর অতিরিক্ত অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়।

যুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অচিরেই পাল্টা আক্রমণ আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান এসে স্ট্রাপিং কিরে আর রকেট হামলা চালাতে থাকে।একইসাথে পনেরো/বিশটি গানবোট যোগে সোজাসুজি পূর্বদিকে ভূঞাপুরে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলো বিমান হামলা আর গানবোটের মর্টার শেলের ফায়ারিং এর ছত্রছায়ায় দলে দলে পাকসেনা তীরে নামতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলে নেন। ইতোমধ্যে ভূঞাপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মজুদ রাখা সমস্ত গোলা-বারুদ কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে আবদুল আলীম তালুকদার, আবদুল হামিদ ভোলা, খোদা বখস মিঞা এবং অন্যান্যরা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলেন।

Operation JahajMara

অবশেষে বিজয়

১৯৭১ এর এই যুদ্ধে বিজয় যেমন মুক্তিফৌজ এর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল তেমনই পাকবাহিনীর মনোবল ভেংগে দিয়েছিল। এটা শুনলে অবাক হবেন যে, জাহাজ দখলের লড়াইয়ে বাংলাদেশী সশস্ত্র সেনার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ জন!!!

Facebook Comments

comments