১৯৯১ সালের ২১ শে মে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তামিলনাড়ু রাজ্যের শ্রীপেরামবুদুরে নির্বাচনী প্রচারণাকালে এলটিটিই’র সুইসাইড বম্বার ধানুর দ্বারা সংগঠিত আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। ধারণা করা হয় যে রাজীব গান্ধীর পুনরায় ক্ষমতায় আসা প্রতিহত করতেই এলটিটিই এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

রাজীব গান্ধী ছিলেন ফিরোজ গান্ধী এবং ইন্দিরা গান্ধীর জ্যেষ্ঠ পুত্র।। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণা সম্পন্ন একজন তরুণ, পেশায় পাইলট। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে আসতে উৎসাহী ছিলেন না। ক্যামব্রিজে অধ্যায়নকালে ইতালীয় বংশোদ্ভুত আন্তোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে তিনি আন্তোনিয়া মাইনোর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, আন্তোনিয়া মাইনো পরবর্তীতে সোনিয়া গান্ধী নামে পরিচিত হন। ১৯৮০ সালে ছোট ভাই সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী অনিচ্ছা সত্বেও মায়ের অনুরোধে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে রাজীব গান্ধী ভারতের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালের ২রা ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর পদত্যাগ করার আগে পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

 

 

হত্যাকাণ্ডের পটভূমিঃ

১৯৯০ সালের মাঝামাঝি। শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহ তখন চরমে। বিদ্রোহী এলটিটিই নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ জাফনার গভীর জঙ্গল থেকে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। এমনই এক সময় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করলেন, পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি শ্রীলঙ্কায় আবার আইপিকেএফ (ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনী) পাঠাবেন। রাজীব গান্ধী তাঁর প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তামিল বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধানে শ্রীলঙ্কায় আইপিকেএফ মোতায়েন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয় এবং রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। রাজীব গান্ধী আবার ক্ষমতায় এলে আবারও শ্রীলঙ্কায় আইপিকেএফ মোতায়েন করা হবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। তাই প্রভাকরণ রাজীব গান্ধীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে এলে নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা অনেক কঠিন হবে বুঝতে পেরে এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণ নির্বাচনের আগেই রাজীব গান্ধীকে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।

এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণ

১৯৯০ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে প্রভাকরণ তার চার বিশ্বস্ত যোদ্ধা বেবি সুব্রামানিয়াম, মুরুগান, মুথুরাজা এবং শিভারাসানকে ডেকে পাঠান। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই প্রভাকরণ তার চার সহকর্মীকে নিয়ে রাজীব গান্ধীকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। চারজনকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। বেবি সুব্রামানিয়ামের উপর দায়িত্ব ছিল হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে ঘাতকদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। মুথুরাজাকে দায়িত্ব দেয়া হয় মাদ্রাজে একটি বেস তৈরি করার যেখান থেকে জাফনা ও মাদ্রাজের মাঝে ওয়্যারলেস মেসেজ আদান প্রদান করা যাবে। মুরুগানকে রাখা হয় বেবি সুব্রামানিয়াম ও মুথুরাজার ব্যাকআপ হিসেবে, পরিকল্পনা ছিলো বেবি সুব্রামানিয়াম ও মুথুরাজা প্রাথমিক কাজ শেষ করার পর মাদ্রাজ ত্যাগ করবে এবং মুরুগান তাদের দায়িত্ব পালন করবে। আর হত্যা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ছিল শিভারাসানের উপর।

প্রশ্ন জাগতে পারে, এলটিটিই কেন হত্যাকাণ্ডের জন্য মাদ্রাজকে বেছে নিয়েছিল, আর দুই এলটিটিই যোদ্ধা বেবি সুব্রামানিয়াম এবং মুথুরাজা মাদ্রাজে কি করছিল?

এর উত্তর পেতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এলটিটিই তামিলদের জন্য আলাদা স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই বিদ্রোহ দমনে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী এলটিটিই বিদ্রোহীদের পাশাপাশি অসংখ্য নিরীহ তামিল জনগণকে হত্যা করে, গৃহহীন হয় অগণিত তামিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অসংখ্য তামিল দেশত্যাগ করে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। আর অপেক্ষাকৃত দরিদ্র তামিলরা পাশের দেশ ভারতের তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নেয়। জাতিগত মিল থাকায় ভারতীয় তামিলরা শ্রীলঙ্কান তামিলদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং এলটিটিইর দাবির প্রতিও তাদের সমর্থন ছিল। এমনকি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বিদ্রোহী তামিলদের ট্রেনিংও প্রদান করেছিল। আর এভাবেই মাদ্রাজ তথা তামিলনাড়ুতে এলটিটিই’র বেশকিছু শক্ত ঘাঁটি তৈরি হয়।

 

হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতিঃ

বেবি সুব্রামানিয়াম এবং মুথুরাজা মাদ্রাজে ফিরেই কাজে লেগে পড়ে। এলটিটিই’র প্রথম লক্ষ্য ছিল কিছু স্থানীয় লোক রিক্রুট করা যারা ঘাতকদের আশ্রয় এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করবে। মাদ্রাজের প্রভাবশালী ফটোগ্রাফার শোভা সুন্দারাম একজন এলটিটিই সমর্থক ছিল এবং শ্রীলংকা থেকে পালিয়ে আসা তামিলদের সহায়তা করে আসছিল। বেবি সুব্রামানিয়াম এবং মুথুরাজা বহু আগে থেকেই তার ফটো এজেন্সিতে নিয়মিত যাতায়াত করত। সেখানেই তারা পেয়ে যায় তাদের প্রথম শিকার, ভাগ্যনাথান-কে।

ভাগ্যনাথান ছিল একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। তার ইচ্ছা ছিল একটি পলিটিক্যাল জার্নাল বের করার। আর্থিক অসমর্থতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। ভাগ্যনাথানের পরিবার দেনায় ডুবে ছিল। তার বোন নলিনী একটি অফিসে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতো। সেই অফিসেই ভাগ্যনাথান ষ্টেশনারী সরবরাহ করতো। আর তার মা একটি নার্সিং হোমে কাজ করতো। সেই নার্সিং হোমের দেয়া কোয়ার্টারেই তারা বসবাস করছিলো। কিন্তু একসময় নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ তাদের কোয়ার্টারে খালি করার নির্দেশ দেয়। দেনার দায়, ওদিকে কোয়ার্টারে খালি করার নির্দেশ, সবমিলিয়ে পরিবারটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আর এ সুযোগটিই নেয় এলটিটিই। ভাগ্যনাথানকে দলে টানতে তাদের খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি।

ওদিকে মুথুরাজাও বসে নেই। এলটিটিই’র সকল মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ছবি তোলা এবং ভিডিও করা। মিশনের ছবি এবং ভিডিও নিয়ে এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণের খানিকটা অবসেশন ছিল। তিনি নিজে সকল মিশনের ছবি এবং ভিডিও পর্যবেক্ষণে করতেন। গেরিলাদের উজ্জীবিত করার জন্যে এই ছবি এবং ভিডিওগুলো এলটিটিই’র ট্রেনিংয়েও দেখানো হত।

রাজীব গান্ধী কিলিং মিশন কাভার করার জন্য এলটিটিই’র প্রয়োজন ছিল দুইজন ফটোগ্রাফার। মুথুরাজা শোভা সুন্দারামের কাছে দুইজন ফটোগ্রাফার চায়। শোভা সুন্দারাম তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় দুই তরুণ ফটোগ্রাফার রবি শঙ্করণ এবং হরিবাবুর সাথে। রবি শঙ্করণ এবং হরিবাবু দুজনেই আগে থেকেই এলটিটিই’র সমর্থক ছিল। মুথুরাজা তাদের রিক্রুট করে নেয়।

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে জাফনা থেকে মাদ্রাজে পা রাখে দুই এলটিটিই যোদ্ধা জয়াকুমারান এবং রবার্ট পায়াস। তারা এসে প্রথমে জয়াকুমারানের আত্মীয় আরিভুর সাথে থাকতে শুরু করে। আরিভু ছিল কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমাধারী এবং ইলেকট্রনিক্ এক্সপার্ট। সে নিজেও এলটিটিই’র কর্মী ছিল, যদিও ইতিপূর্বে কোন মিশনে অংশ নেয়নি। আরিভুকে জানানো হয় যে এটি একটি স্পেশাল মিশন, কিন্তু টার্গেট সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হয়নি।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে মুরুগান মাদ্রাজে চলে আসে। তারপর সে জাফনায় অবস্থানরত শিভারাসানকে মেসেজ পাঠায় মাদ্রাজে আসার জন্য। মার্চের প্রথম সপ্তাহে শিভারাসান মাদ্রাজে আসে। সে জয়াকুমারানের বাসায় উঠে। শিভারাসানকে সব আশ্রয়স্থল এবং এখন পর্যন্ত রিক্রুট করা সবার সম্পর্কে ব্রিফিং দেয়া হয়। মার্চের শেষদিকে বেবি সুব্রামানিয়াম এবং মুথুরাজা জাফনায় ফিরে যায়। মাদ্রাজে তাদের কাজ শেষ। এখান থেকে শিভারাসান মিশনের মূল দায়িত্ব নিয়ে নেয়। তখনও পর্যন্ত ভাগ্যনাথান, নলিনী, পদ্মা, রবি শঙ্করণ, হরিবাবু, আরিভু কেউ মিশনের ডিটেইলস কিংবা টার্গেট সম্পর্কে জানতো না, তারা শুধু বুঝতে পেরেছিল এলটিটিই বড়সড় কোন পরিকল্পনা করছে।

এবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, আত্মঘাতী হামলাকারী নির্বাচন করা। শিভারাসান আগেই আত্মঘাতী হামলাকারী ঠিক করে রেখেছিল। তাদের নিয়ে আসতে সে জাফনায় ফিরে যায়। জাফনায় সে প্রভাকরণের সাথে দেখা করে এবং তাকে মিশনের অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফিং দেয়। প্রভাকরণ তাকে আসল অপারেশনের আগে কয়েকটি ট্র্যায়ালের আদেশ দেয় এবং পুরো মিশনের ছবি তোলার কথা মনে করিয়ে দেয়। শিভারাসান তার দুজন আত্মীয় ধানু এবং সুভা নামের দুটি মেয়েকে সাথে নিয়ে মাদ্রাজে ফিরে আসে। ধানু এবং সুভা দুজনেই ব্ল্যাক টাইগার নামে পরিচিত এলটিটিই’র সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানু ছিল মূল আত্মঘাতী হামলাকারী, সুভাকে রাখা হয়েছিলো তার ব্যাকআপ হিসেবে। ধানু এবং সুভাকে নলিনীর বাসায় উঠানো হয়।

এবার শিভারাসানের টিম পুরোপুরি তৈরি। এপ্রিলের ১৮ তারিখ মাদ্রাজের মারিনা বিচে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনী জনসভায় শিভারাসান তার টিম নিয়ে প্রথম ট্র্যায়াল দেয় যেখানে রাজীব গান্ধী এবং জয়ললিতা উপস্থিত ছিলেন। তারা দুই নেতার খুব একটা কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি, তবে ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারন করা হয়। লোকাল রিক্রুটদের বলা হয় এলটিটিই বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত হয়ে বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছবি তোলার চেষ্টা করবে যাতে পরবর্তীতে তাদের কাছে তামিলদের দাবি-দাওয়া নিয়ে গেলে ছবিগুলো দেখিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা যায়। কিন্তু সবাই টের পাচ্ছিলো, ব্যাপারটা মোটেও এত সামান্য কিছু নয়।

মিশন শুরু হওয়ার পর থেকে জাফনা এবং মাদ্রাজের মধ্যে প্রচুর কোডেড ওয়্যারলেস মেসেজ আদান-প্রদান হয়। এরকম বেশকিছু কোডেড মেসেজ ভারতীয় গোয়েন্দারা ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়, কিন্তু যতদিনে তারা কোড ব্রেক করে মেসেজ উদ্ধার করতে সমর্থ হয় ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ‘’ আভাস পেয়েছিল রাজীব গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে, কিন্তু ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সেটিকে গুরুত্ব দেয় নি। জার্মান ইন্টেলিজেন্স থেকেও আইবিকে একজন শ্রীলংকান তামিল বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের ঘন ঘন মাদ্রাজে আসার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় সেটিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল এলটিটিই এত বড় প্ল্যান করতে পারে না। যার মূল্য পরে রাজীব গান্ধীকে জীবনের বিনিময়ে দিতে হয়েছিল।

দুটি সফল ট্র্যায়ালের পর শিভারাসান আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এখন শুধু সঠিক সময় এবং সুযোগের অপেক্ষা। এবং সেই সুযোগ খুব দ্রুতই এসে যায়। ১৯ শে মে ঘোষণা করা হয় যে দুদিন পর অর্থাৎ ২১ শে মে শ্রীপেরামবুদুরে কংগ্রেসের নির্বাচনী জনসভা অনুষ্ঠিত হবে যেখানে রাজীব গান্ধী উপস্থিত থাকবেন। শিভারাসান ভেবে দেখে এটাই সবচেয়ে ভালো এবং সর্বশেষ সুযোগ। যদিও মাদ্রাজে ধানু ব্যর্থ হলে দিল্লিতে এলটিটিই’র আরো একটি ব্যাকআপ টিম তৈরি ছিল, কিন্তু শিভারাসান আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা মাদ্রাজেই সফল হবে এবং দিল্লির ব্যাকআপ টিমের দরকার পড়বে না।

 

ডি-ডেঃ

২রা ডিসেম্বর, সন্ধ্যা ৬ টা, বিশাখাপত্তনম। রাজীব গান্ধী অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তনমে একটি জনসভায় ভাষণ শেষে মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তার প্লেনের পাইলট জানালেন যে প্লেনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে এবং মাদ্রাজ যাত্রা সম্ভব নয়। রাজীব গান্ধী মাদ্রাজ যাত্রা বাতিল করে স্টেট গেস্ট হাউসে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। গেস্ট হাউসে ফেরার পথে রাজীব গান্ধীকে এস্কর্ট প্রদান করা পুলিশ টিম একটি ওয়্যারলেস মেসেজ রিসিভ করে যে, প্লেনের ত্রুটি সারানো হয়েছে এবং প্লেন যাত্রার জন্য তৈরি। রাজীব গান্ধী তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে এয়ারপোর্টে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তার পার্সোনাল সিকিউরিটি টিম আলাদা একটি গাড়িতে ছিল। তারা গেস্ট হাউসে পৌঁছে জানতে পারে রাজীব গান্ধী মাঝপথ থেকে এয়ারপোর্টে ফিরে গেছেন। রাজীব গান্ধী এতোটাই তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন যে পার্সোনাল সিকিউরিটি টিমের জন্য অপেক্ষা না করে তাদের ছাড়াই মাদ্রাজে রওয়ানা হয়ে যান।

সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট, শ্রীপেরামবুদুর। মিটিংস্থলে পৌঁছে শিভারাসান, ধানু, সুভা, নলিনী এবং হরিবাবু ভিআইপি এনক্লোজারের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। এ সময় সাব-ইন্সপেক্টর অনুসূয়া কুমারী তাদের প্রশ্ন করলে হরিবাবু নিজেকে প্রেসের ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচয় দেয়। অনুসূয়া তাদের জানায় যে, রাজীব গান্ধীর পৌছাতে দেরি হবে এবং তারা যাতে সেখান থেকে সরে যায়। সুভা এবং নলিনী সেখান থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য মহিলাদের সাথে ভিড়ের মাঝে বসে পড়ে।

ওদিকে শিভারাসান মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তার পরনে ছিল সাদা কুর্তা পাজামা আর হাতে নোটপ্যাড, যাতে তাকে পুরোদস্তুর সাংবাদিক মনে হয়। ব্যাকআপ হিসেবে শিভারাসান একটি পিস্তল সঙ্গে রেখেছিলো।

মেইন রোড থেকে মঞ্চ পর্যন্ত লাল গালিচা বিছানো হয়েছিলো, গাড়ি থেকে নেমে যে লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে রাজীব গান্ধী মঞ্চে যাবেন। লাল গালিচার পাশে মহিলারা ফুলের মালা হাতে নিয়ে রাজীব গান্ধীকে বরণ করে নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। ধানু চন্দনের মালাটি নিয়ে সেই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। তার পরনে ছিল কমলা রঙের কামিজ এবং সবুজ ওড়না। কামিজের নিচে সে বেল্ট বোমা লাগানো ভেস্টটি পরে ছিল। হরিবাবু ক্যামেরা নিয়ে ধানুর কাছাকাছি অবস্থান নেয়।

রাত ১০.০৫ মিনিট, শ্রীপেরামবুদুর। রাজীব গান্ধীর গাড়িবহর শ্রীপেরামবুদুরের জনসভাস্থলে এসে পৌছায়। তিনি পৌঁছাতেই নেতাকর্মীরা ফুলের মালা এবং শাল পড়িয়ে দিয়ে বরণ করার জন্য তার চারপাশে ভিড় করলো। একটি দরিদ্র বালকের সাহায্যের আবেদন সংবলিত চিঠির অনুবাদ রাজীব গান্ধীকে পড়ে শোনানো হয়। তারপর রাজীব গান্ধী নেতা কর্মীদের ভিড় ঠেলে লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ মিটার দূরে তৈরি করা মঞ্চের দিকে এগোতে শুরু করেন। ভিড় প্রচণ্ড হওয়ায় রাজীব গান্ধীর এগোনোর গতি ছিল খুব ধীর। এগিয়ে যাবার পথে তিনি নেতাকর্মীদের নিকট হতে মালা ও শাল গ্রহণ করছিলেন।

Rajiv Gandhi at Sriperumbudur, Tamil Nadu, on 21 May 1991 just before the bomb blast that killed him.

রাজীব গান্ধীকে মালা পড়াচ্ছেন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ধানু

ধানু মালা হাতে রাজীব গান্ধীর দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনি সাব-ইন্সপেক্টর অনুসূয়া তাকে রাজীব গান্ধীর কাছে যেতে বাধা দেয়। কিন্তু রাজীব গান্ধী অনুসূয়াকে বলেন “Let everyone have a turn. Don’t worry, Relax.” এটাই ছিল তার শেষ কথা। অনুসূয়া ধানুকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে যায়। ধানু রাজীব গান্ধীর গলায় মালাটি পড়িয়ে দেয়। রাজীব গান্ধী হেসে মালাটি হাতে নিয়ে পাশে থাকা একজন কর্মীকে দেন। ধানু প্রণাম করার ছলে খানিকটা ঝুঁকে কোমরে লাগানো বোমা অ্যাক্টিভেট করে দেয়। সাথে সাথে ২০ বর্গমিটার জায়গা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে।

বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধীর তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণের ধাক্কা খুব কাছ থেকে তার মুখমণ্ডল ও বুকে আঘাত করে, ফলে তার দেহ স্রেফ একটি মাংসস্তুপে পরিণত হয়। পরবর্তীতে পায়ে থাকা লট্টো জুতো এবং হাতঘড়ি দেখে তার লাশ শনাক্ত করা হয়। বিস্ফোরণে ধানুর দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজীব গান্ধী এবং ধানু ছাড়াও আরও প্রায় ২৫ জন এ বিস্ফোরণে নিহত হয়।

লেখাঃ তানজীর হাসান

Facebook Comments

comments