সুখোই সু-৩৪ হচ্ছে রাশিয়ার তৈরি দুই ইঞ্জিন ও দুই সিট বিশিষ্ট একটি অল-ওয়েদার, মিডিয়াম রেঞ্জের সুপারসনিক বোম্বার-ফাইটার বা স্ট্রাইক এয়ারক্রাফট, যার ন্যাটো রিপোর্টিং নেইম হচ্ছে, ফুলব্যাক

এই এয়ারক্রাফটি ১৯৯০ সালে এর প্রথম ফ্লাইং সম্পন্ন করে এবং ২০১৪ সালে প্রথম রাশিয়ান বিমানবাহিনী তে সার্ভিসে আসে।

সুখোই সু-২৭ ফ্ল্যাংকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা, সুখোই সু-৩৪ হচ্ছে এমন একটি ইউনিক বোম্বার যেটি দিয়ে একাধারে গ্রাউন্ড ও নেভাল টার্গেটকে ধ্বংস করা, এয়ার সুপ্রিমেসি অর্জন ও গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করা যায়।

বিমানটি তে আছে আধুনিক এভিওনিক্স, মাল্টিপারপোজ লং রেঞ্জ রাডার, বিল্ট ইন ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট। আছে ইনফ্লাইট রিফিউলিং সুবিধা ও। এটি একসাথে এয়ার টু সার্ফেস ও এয়ার টু এয়ারে একাধিক টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম। এর হাই এন্ডুরেন্স ইঞ্জিন অনেকক্ষন একটানা চলতে সক্ষম।

সু-৩৪ বিমানটি মূলত সু-২৪ কে রিপ্লেস করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি ফাইটার বোম্বার হিসেবে বানানো হলেও এটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ মাল্টিরোল ফাইটারের সকল গুণাবলি রয়েছে।

এই বিমানটি ডিজাইন করা হয়েছে লং রেঞ্জ স্ট্রাইক, ট্যাকটিকাল স্ট্রাইক, রিকনেসেন্স ও ন্যাভাল মিশনের জন্য। যেটি দিয়ে দিনে-রাতে, যেকোন আবহাওয়ায় এমনকি হেভি ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার পরিবেশে ও ছোট, দূরবর্তী এবং গতিশীল টার্গেট কে ধ্বংস করা যায়। আর এর ফেরি রেঞ্জ হচ্ছে ৪০০০ কি.মি., যা থেকে বোঝা যায় এটি একটি ১০০০ কিমি এর কমব্যাট মিশন অনায়াসে করতে সক্ষম।

Sukhoi Su-34

এটির হার্ট হিসেবে রয়েছে এর ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম যা ওকেবি লিনেট কর্তৃক ডিজাইন কৃত ভি০০৪ পিইএসএ রাডার। রাডার টি ৩^২ মিটার RCS বিশিষ্ট টার্গেটকে ২০০-২৫০ কিমি দূর থেকে ট্র‍্যাক করতে পারে।

এর আরেকটি অন্যতম ফিচার আছে যা অনেকেই জানেন না, ৫ম প্রজন্মের বিমানে এটি দেখা যায়; তা হল এর পিছনে দুই ইঞ্জিনের মাঝখানে যে বিশাল স্টিং বা হুলের ন্যায় দেখা যায় তাতে একটি রিয়ার ওয়ার্ড ফেসিং ওয়ার্নিং রাডার আছে যা পিছনে শর্ট রেঞ্জে বিমান ডিটেক্ট ও মিসাইল গাইড করতে পারে। এজন্য সু-৩৪ পিছে না ঘুরেই পিছনের বিমান ধ্বংস করতে পারে !

Su-34

ইঞ্জিন দুটির মাঝখানে রিয়ার ওয়ার্ড ফেসিং ওয়ার্নিং রাডার

এই বিমানটির লিস্টভর্তি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বহন করতে পারে। যার মধ্যে একটা আলোচিত অস্ত্র হল কেএইচ-৫৯এমই টিভি গাইডেড মিসাইল, এটি গ্রাউন্ড টার্গেটে ১০০ কিমি এর উপর টেস্টে হামলা করতে সফল হয়েছে। এটি মিসাইলের সামনের ক্যামেরার মাধ্যমে ওয়েপন্স অফিসার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এছাড়াও এতে সিকার রয়েছে।

এর এয়ার টু এয়ার ক্যাপাবিলিটিও মারাত্মক, একসাথে ৬ টি কে-৭৭ মিসাইল এবং ৬ টি কে-৭৪এম মিসাইল নিয়ে এয়ার টু এয়ার মিশন করতে সক্ষম অথবা আটটি আর-২৭ এবং ৪টি কে-৭৪এম মিসাইল বহনে সক্ষম !

এছাড়াও এর আরেকটি অন্যতম ফিচার হল এর বিল্ট ইন ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম !

হ্যা, এটি ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সাপোর্ট ও দিতে পারে (Khibiny ECM System)। ২০১৬ সালে পিকা-এম নামের একটি পিইএসএ রাডার (৩০০ কিমি রেঞ্জ) পরীক্ষায় সফল হয়েছে যা পরবর্তি বিমানগুলোয় স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে থাকবে।

এছাড়াও এটির আলাদা কোনো টার্গেটিং পড লাগেনা, স্ট্যান্ডার্ড বিল্ট ইন ইলেক্ট্রো অপটিকাল পড লাগানো আছে যা খুব শীঘ্রই ফ্রান্সের থেলস এর বানানো ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল সিস্টেম দ্বারা রিপ্লেস করা হবে।

 Su-34's Cockpit

সু-৩৪ এর ককপিট

এটির ককপিটে পাইলট পাশাপাশি বসে যার সুবিধা হল ডুপ্লিকেট জিনিসের দরকার হয়না। পাইলট বাম পাশে বসে। ককপিটে প্রবেশ করতে হলে বিমানের নোজ হুইলের হ্যাচের মাধ্যমে প্রবেশ করতে হয়।

Su-34's Cockpit Entrance Hatch

সু-৩৪ এর ককপিটে প্রবেশের হ্যাচ

এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ আনরিফিউল্ড ৪০০০ কিমি, রিফিউলিং করে সর্বোচ্চ ১২০০০ কি.মি. মিশন পরিচালনা করা যায়। এর এএল-৩১এফএম১ খুবই রিলায়েবল এবং আগের ভার্সন থেকে আপগ্রেড করা। এটি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২০০০ কি.মি. গতি বিমানটিকে দিতে সক্ষম।

এ বিমানের স্পেশাল ফিচার হল এর লং এন্ডুরেন্স ফ্লাইটের সুবিধার্থে পাইলটদের জৈবিক কাজের জন্য একটি টয়লেট ও মিনি কিচেন আছে; যা দীর্ঘ সময় ফ্লাইং এর জন্য ব্যবহৃত হয়। আর পাশাপাশি দুই সিট হওয়ায় পিছে কিছু ফাকা জায়গা থাকে যেখানে একজন পাইলট শুয়ে থাকার ব্যবস্থাও আছে।

পাইলট ইচ্ছা করলে তার ন্যাভিগেটর এর কাছে কন্ট্রোল দিয়ে করিডরে রেস্ট নিতেও পারেন !

Su-34's Toilet

সু-৩৪ এর টয়লেট

এর ককপিট ১৭মিমি আর্মার দিয়ে মোড়ানো এবং পাইলটের জন্য ইজেকশন সিট রয়েছে।

অস্ত্রভান্ডার হিসেবে রাশিয়ার প্রায় সকল এয়ার লঞ্চড মিসাইল বহন করতে পারে। প্রায় ১২ টন অস্ত্র বহনে সক্ষম। খুবই প্রিসাইজ ভাবে এটাক করতে সক্ষম বিভিন্ন গাইডেড বোমামিসাইল বহন করতে পারে। এছাড়াও এটি ৩০০০ কি.মি. পাল্লার ক্রুজ মিসাইল বহন করতেও সক্ষম !

আত্মরক্ষার জন্য আরো দুই ধরণের ইসিএম পড উইংটিপে বহন করতে পারে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল এটির ম্যাক্সিমাম টেক অফ ওজন ৪৫ টন ! এর বারোটা হার্ডপয়েন্টে সর্বোচ্চ ১২ টন অস্ত্র নেয়া যায়, যা একটা খালি এফ-১৬ এর প্রায় সমান।

কিন্তু এরপরেও এটি ৯ জি ম্যানুয়েভার নিতে সক্ষম, যা অনেক আধুনিক ফাইটার বিমান ও পারে না !

এয়ার শোতে একমাত্র বোম্বার হিসেবে কোবরা ম্যানুয়েভার এই বিমানই দিতে পারে।

এয়ার শোতে দেখলেই বোঝা যায় এর ম্যানুয়েভার ক্ষমতা আধুনিক কিছু ফাইটারের চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ৩৬ মিলিয়নের এই বিমান রাশিয়া ছাড়াও আলজেরিয়া ব্যবহার করে ১২ টি এবং এর সুফলে আরো ৪০ টি অর্ডারের ইচ্ছা পোষণ করেছে।

 

এবার সংক্ষেপে এই এয়ারক্রাফটি সম্পর্কে জেনে নিইঃ

সাধারন বৈশিষ্ট্যঃ

  • ওরিজিনঃ রাশিয়া
  • দৈর্ঘ্যঃ ২৩.৩৪ মিটার
  • উচ্চতাঃ ৬.৩৬ মিটার
  • উইং স্প্যানঃ ১৪.৫ মিটার
  • ক্রুঃ ২ জন
  • নরমাল টেক অফ ওজনঃ ৩৯,৯৯০ কিলোগ্রাম
  • সর্বোচ্চ টেক অফ ওজনঃ ৪৫,১০০ কিলোগ্রাম
  • সার্ভিস সিলিংঃ ১৪,০০০ মিটার
  • জ্বালানী বহন ক্ষমতাঃ ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল ট্যাংক মিলে ১৯৩০০ কেজি
  • লো অলটিটিউড স্পীডঃ ১৩০০কি.মি.
  • ম্যাক্সিমাম অলটিটিউড স্পীডঃ ১৯০০কি.মি.
  • সর্বোচ্চ জি লোডঃ ৯ জি
  • ফেরি রেঞ্জঃ ৪৫০০কি.মি.
  • ইউনিট কস্টঃ ৩৬ মিলিয়ন ডলার

 

এবার দেখে নিই এর অস্ত্রসস্ত্র বা আর্মামেন্ট এর তালিকা সমূহঃ

এয়ার টু সার্ফেস মিসাইলঃ

কেএইচ-২৫এমএল, কেইএচ-২৯, কেএইচ-৩৮, কেএইচ-৫৮, কেএইচ-৫৯ মিসাইল বহন ও লঞ্চ করতে পারে। প্রায় শব্দের দিগুণ গতি সম্পন্ন এই মিসাইল গুলো মূলত ব্রিজ, কংক্রিট এর তৈরী হ্যাঙ্গার এবং রানওয়ে সহ ভারী স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে। তাছাড়া প্রয়োজনে এগুলোকে এন্টিশিপ মিসাইল হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং এগুলো সর্বোচ্চ ১০,০০০ টনের জাহাজ কে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম।

এন্টি শিপ মিসাইলঃ

কেএইচ-৩১এ, কেএইচ-৩৫, কেএইচ-৪১ এবং পি-৮০০ অনিক্স বহন ও লঞ্চ করতে পারে। এই মিসাইল গুলো ডেডিকেটেড এন্টিশিপ মিসাইল। এবং পি-৮০০ অনিক্স কে বলা যায় বিশ্বখ্যাত ব্রামোস মিসাইল এর পিতামহ।

এন্টি রেডিয়েশনঃ

কেএইচ-২৫এমপি, কেএইচ-৫৮ এবং কেএইচ-৩১পি। এই এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল গুলোর কাজ হলো শত্রুপক্ষীয় রাডার এবং জ্যামার সিস্টেম গুলোকে ধ্বংস করা।

বোম্বঃ

এই ফাইটার বোম্বার টি KAB ফ্যামিলির ৬ প্রকার বোম্ব সহ ১৪ প্রকার বোম্ব ড্রপ করতে পারে। যেগুলো সাধারণত লেজার গাইডেড, টিভি গাইডেড, স্যাটেলাইট গাইডেড এবং ফ্রি-ফল বোম্বস। মিশন অনুযায়ী বিমানটিকে সজ্জিত করে পারফেক্টভাবে মিশন পরিচালনা করা যায়।

রকেটঃ

সুখোই সু-৩৪ বিমান টি সর্ব মোট ০৪ ধরনের রকেট বহন ও ছুঁড়তে পারে।

ক্যাননঃ

এয়ারক্রাফটটিতে ১৮০ রাউন্ড হেভি বুলেট সহ একটি ৩০মি.মি. GSH-301 ক্যানন, যেটি প্রতি মিনিটে ১৫০০ রাউন্ড বুলেট ছুঁড়তে সক্ষম।

 

সু-৩৪ এর কয়েকটি ভ্যারিয়্যান্টস্ আছে। যার মধ্যে সু-৩৪ এর প্রস্তাবিত এফএন ভ্যারিয়্যান্ট, লং রেঞ্জের ম্যারিটাইম এটাক ও এন্টি-সাবমেরিন ওয়্যারফেয়ার বিমান, আর সু-৩৪ এম-এফ, একটি মাল্টিরোল ফাইটার-বোম্বার হিসেবে কাজ করে।

এক কথায় বোম্বার+ফাইটার হিসেবে সুখোই সু-৩৪ একটি অসাধারণ বিমান। দামে ও মানে রাশান এই বিমানটি এক কথায় অসাধারণ। প্রায় ২০০+ সু-৩৪ সার্ভিসে আনার প্ল্যান রয়েছে এবং এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অলরেডি ১১৪ টির মত সু-৩৪ তৈরি করা হয়েছে।

Sukhoi Su-34

Sukhoi Su-34

Sukhoi Su-34

Sukhoi Su-34

Sukhoi Su-34

Facebook Comments

comments