গেরিলা বাহিনীঃ

মুক্তিবাহিনীর প্রাণ ছিলেন গেরিলারা। গেরিলাদের কাজ ছিল আকস্মিক আক্রমণ করে খুব দ্রুত সরে যাওয়া। তাই তাঁদের অস্ত্রও ছিল তুলনামূলক হালকা ও ছোটখাটো। যেন সহজে বহন করা যায় এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে রিট্রিট করা যায়।

বেশিরভাগ সময় গেরিলা কমান্ডারের হাতে থাকতো স্টার্লিং এসএমজি। কখনো বা স্টেনগান। সদস্যদের কাছে মূলত থ্রী নট থ্রী রাইফেল বেশি দেখা যেতো। শেষদিকে কিছুক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান এসএলআরের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। গেরিলা দলগুলোর কাছে সাধারণত এলএমজি থাকতো না। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় কখনো কখনো চাইনিজ টাইপ-৫৬ (আরপিডি) দেওয়া হতো। কদাচিত ব্রেনগানও দেখা যেতো। আর ঢাকা শহরের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বড় অংশই স্টার্লিং ও স্টেন ব্যবহার করতেন।

গ্রেনেড হিসেবে বেশিরভাগ এইচই-৩৬ ব্যবহৃত হতো। আর থাকতো এনারগা-৯৪ এন্টিট্যাংক গ্রেনেড, যেটি রাইফেল থেকে ফায়ার করা হতো।এন্টি পারসোনেল ও এন্টি ট্যাংক – উভয় মাইনই প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। খুব সম্ভবত ব্রিটিশ মার্ক-২, মার্ক-৫ ও মার্কিন এম-১৪ ব্যবহৃত হতো।

নিয়মিত বাহিনীঃ

নিয়মিত বাহিনীর ছিল দুটি অংশ – সেক্টর ট্রুপস ও ব্রিগেড ট্রুপস। উভয়েরই অস্ত্রশস্ত্র প্রায় একই রকম হলেও ব্রিগেড ফোর্সগুলো তুলনামূলক বেশি ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতো।

অফিসারদের জন্য ছিল টাইপ-৫৬ অ্যাসল্ট রাইফেল (একে-৪৭ এর চাইনিজ ভার্সন)। জেসিওরা কখনো কখনো স্টার্লিং বা স্টেন নিতেন, তবে সংখ্যায় কম। সৈনিকদের হাতে ইন্ডিয়ান এসএলআর, চাইনিজ এসকেএস বা থ্রী নট থ্রী রাইফেল থাকতো।

এলএমজি হিসেবে চাইনিজ টাইপ-৫৬ ও ব্রেনগান উভয়ই ব্যবহৃত হতো। মিডিয়াম মেশিনগান হিসেবে চেক জেডবি-৫৩, চাইনিজ টাইপ-৫৩, জার্মান লিজেন্ডারি এমজি-৪২, এবং অল্পকিছু ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভিকার্স মেশিনগান ব্যবহৃত হতো।

গ্রেনেড হিসেবে এইচই-৩৬ এবং এন্টি ট্যাংক গ্রেনেড হিসেবে এনারগা-৯৪ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। আরো ছিল ৪০ মিমি চাইনিজ রকেট লঞ্চার, যা দিয়ে মূলত লরি ও ছোটখাটো ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করা হতো। এম-১৮ ও এম-৪০ রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করা হতো মূলত লঞ্চ ও বাংকারের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ বড় অপারেশনে রিকয়েললেস রাইফেল কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

মর্টারের মধ্যে ব্রিটিশ দুই ইঞ্চি মর্টার অল্পকিছু ক্ষেত্রে শত্রুর ঘাঁটি আক্রমণে ব্যবহৃত হলেও তাদের মূল কাজ ছিল সংকেত প্রদান করা। ইনফ্যান্ট্রি সাপোর্ট হিসেবে সম্ভবত ব্রিটিশ এমএল-৩ ও চাইনিজ টাইপ-৬৩ সহ বেশ কয়েকটি মডেলের ৮১ মিলিমিটার মর্টার ব্যবহার করা হতো। তবে বেশিরভাগ মর্টারেরই সাইট ছিল না। ফায়ার করতে হতো আন্দাজের ওপর।

কনভেনশনাল যুদ্ধের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র আর্টিলারি শুরুতে ছিল না। পরবর্তীতে, আগস্টে যুক্ত হয় ভারতীয় ৩.৭ ইঞ্চি মাউন্টেন গান, যার নাম ছিল মুজিব ব্যাটারী। এগুলোই ছিল প্রথম আর্টিলারি গান। এছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে ১০৫ মিলিমিটার গানও ব্যবহার করা হতো।

মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ শুরু করেছিল খুবই সামান্য অস্ত্র নিয়ে। শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে তা বলতে গেলে কিছুই নয়। ধীরে ধীরে বাহিনী নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে, যদিও কখনো তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি।

তবুও দিনশেষে বিজয়ী ছিলাম আমরাই। দেশপ্রেম, সাহস ও একতা থাকলে একটি ছোট বা দুর্বল বাহিনীও বড় ও শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম, তার অনন্য উদাহরণ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

লেখা – ফেরদৌস ইউসুফ

Facebook Comments

comments