ব্যাটল অব ওকিনাওয়া ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্যাসিফিক ফ্রন্টের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ, একইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে সর্বশেষ বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে একে “টাইফুন অব স্টিল”, “রেইন অব স্টিল”, “ভায়োলেন্ট উইন্ড অব স্টিল” ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

মূল হামলা শুরুর আগে মার্কিন নৌবাহিনীর নিউ মেক্সিকো ক্লাস ব্যাটলশিপের বোম্বিং

মার্কিন নৌবাহিনীর নিউ মেক্সিকো ক্লাস ব্যাটলশিপ

জাপানের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার আগে এর আশপাশে অবস্থিত তাদের শক্তিশালী অবস্থানগুলো দখলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর৷ এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা ব্যাপক রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ আইও জিমা দ্বীপ দখল করে। তারপর তাদের লক্ষ্য ঠিক হয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ ওকিনাওয়া

মানচিত্রে ওকিনাওয়া দ্বীপের অবস্থান

মানচিত্রে ওকিনাওয়া দ্বীপের অবস্থান

জাপানের মূল ভূখন্ড থেকে ৫৮০ কিলোমিটার দূরের ওকিনাওয়া দ্বীপের এই লড়াইটি প্রায় তিনমাস স্থায়ী হয়। ১৯৪৫ সালের ১ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইমন বলিভার বাকনার জুনিয়র (যিনি পরে আর্টিলারি হামলায় নিহত হন) এর নেতৃত্বে মার্কিন ১০ম আর্মি ওকিনাওয়ায় উভচর অপারেশন শুরু করে। ১০ম আর্মির অধীনে ছিল দুটি কোর – ৩নং কোর (১, ২ ও ৬ মেরিন ডিভিশন নিয়ে) এবং ২৪নং কোর (৭, ২৭, ৭৭ ও ৯৬ পদাতিক ডিভিশন নিয়ে)। প্রাথমিকভাবে ২ লক্ষ ৮৭ হাজার মার্কিন সেনা অবতরণ করলেও শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। সাথে ছিল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারসহ সুবিশাল নৌবহর। বিপরীতে ওকিনাওয়ার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল জেনারেল ইউশিজিমার নেতৃত্বাধীন জাপানি ৩২তম আর্মি, যার সৈন্যসংখ্যা ছিল আনুমানিক ১ লক্ষ ৩০ হাজার। আরো ছিল শক্তিশালী জাপানি নৌ ও বিমানবাহিনী।

ওকিনাওয়ায় দুই মার্কিন মেরিন

ওকিনাওয়ায় দুই মার্কিন মেরিন

মার্কিন সৈন্যরা উপকূলে অবতরণের পর তেমন কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় নি, এতে তারাও অবাক হয়েছিল। একজন মার্কিন সৈন্যের উক্তি ছিল, “যতক্ষণ বেঁচে থাকবো বলে আশা করেছিলাম, তার চেয়ে বেশি সময় বেঁচে আছি”।

আসলে জাপানিরা লুকিয়ে ছিল দ্বীপের ভেতরের দিকে, বিশেষত দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের ঘন জঙ্গল আবৃত জায়গায়। অসংখ্য পিলবক্স ও বাংকার খুঁড়ে তারা অবস্থান নেয়। ৬ এপ্রিল মার্কিনরা মূল দ্বীপে প্রবেশ করে উত্তরদিক থেকে প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তবে তা খুব বেশি তীব্র ছিল না, অন্তত দক্ষিন ও পশ্চিমাংশের প্রতিরোধের তুলনায়। তাই ২০ এপ্রিলের মধ্যে দুটি জাপানি বিমানঘাঁটিসহ পুরো উত্তরাঞ্চল মার্কিন বাহিনী কবজা করে ফেলতে সক্ষম হয়। কিন্তু আসল লড়াই তখনো বাকি।

জাপানি ১৫০ মিলিমিটার আর্টিলারি গান

জাপানি ১৫০ মিলিমিটার আর্টিলারি গান

ওকিনাওয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর লড়াই হয় দক্ষিণাংশেই। স্থল হামলার পাশাপাশি মার্কিন বিমান ও জাহাজগুলোও জাপানি ‘কামিকাজে’ হামলায় (বিমান নিয়ে আত্মঘাতী হামলা) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জাপানিরা ওকিনাওয়ার দক্ষিণাংশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে এবড়োখেবড়ো ভূমিতে গোপনে অবস্থান নিয়ে ছিল, যাদের আকস্মিক আক্রমণে মার্কিন সেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ওকিনাওয়া দ্বীপে মার্কিন মেরিন সেনাদের লড়াই

ওকিনাওয়া দ্বীপে মার্কিন মেরিন সেনাদের লড়াই

ওকিনাওয়ার দক্ষিণাংশের সুগার লুফ নামক একটি পর্বতে মে মাসের মাঝামাঝি একটি লড়াইয়ে একসপ্তাহের মধ্যে

আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারায়। ১৮ মে এই পর্বতটি দখলের পর মার্কিন বাহিনী ২১ মে কোনিক্যাল পর্বতও দখল করতে সক্ষম হয়। তবে জাপানি সৈন্যদের কেন্দ্রস্থল ছিল শুরি ক্যাসল, তার কিছু দূরে ছিল আর্মি হেডকোয়ার্টার। শুরি ক্যাসলে পৌঁছাতে মার্কিন সেনাদের ২৯ মে পর্যন্ত লেগে যায়। প্রাণ হারায় আরো হাজার হাজার সৈন্য। তবে এরপরও জাপানিরা ছেড়ে কথা বলে নি। বিশেষত তাদের ‘কামিকাজে’ হামলা মার্কিনদের বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল।

কামিকাজে পাইলটদের শেষ বিদায় জানাচ্ছে জাপানি স্কুলছাত্রীরা

কামিকাজে পাইলটদের শেষ বিদায় জানাচ্ছে জাপানি স্কুলছাত্রীরা

শেষপর্যন্ত তিন সপ্তাহের ভয়ংকর লড়াই শেষে ২০ জুন মার্কিন বাহিনী জাপানিদের হেডকোয়ার্টার দখলে সক্ষম হয়। ২৩ জুন জাপানি জেনারেল ইউজিশিমার আত্মহত্যার মাধ্যমে সকল লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে।

ওকিনাওয়া যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। মার্কিন বাহিনীর ১২-১৮ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়, আহত হয় ৪০-৫০ হাজার। ২২১টি ট্যাংক ধ্বংস হয়, ১২টি ডেস্ট্রয়ারসহ ৩৪টি জাহাজ ডুবে যায় ও ৩৮৬টি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৭৬৫টি বিমান বিধ্বস্ত হয়। জাপানি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক বেশি। প্রায় ৮০ হাজার থেকে একলক্ষ সৈনিক নিহত হয়। অবশ্য এর মধ্যে বড় একটা অংশ ছিল ‘সেপ্পুকু’ পদ্ধতিতে (গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে) আত্মহত্যা করা সৈনিক। জাপানের ২৭টি ট্যাংক ধ্বংস হয়, একটি ব্যাটলশীপ ও একটি লাইট ক্রুজার সহ ১৬টি জাহাজ ডুবে যায়, বিমান ধ্বংস হয় ১৪৬৫টি।

নিহত মার্কিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইমন বলিভার বাকনার জুনিয়র

মার্কিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইমন বলিভার বাকনার জুনিয়র

তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি ছিল স্থানীয় জনসাধারণের। প্রায় পাঁচলক্ষ জনসংখ্যার দ্বীপ ওকিনাওয়ার প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিহত হন। এই যুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি আজও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের তাড়া করে ফেরে।

এই ওকিনাওয়ার ভয়ংকর লড়াইয়ের মধ্যেই এক মার্কিন মেডিকের মানবিক লড়াইয়ের গল্প নিয়ে ২০১৬ সালে হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “হ্যাক-স’ রিজ” নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর দর্শক-সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে।

লেখা – ফেরদৌস ইউসুফ

Facebook Comments

comments