পাকিস্তানের এসএসজি কমান্ডোদের পরিচালিত সবচেয়ে দীর্ঘ একক অপারেশন ছিল ২০০৭ সালে রাজধানী ইসলামাবাদের লাল মসজিদে চালানো অপারেশন সাইলেন্স।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এসএসজি (Special Service Group – SSG) কমান্ডোরা পৃথিবীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ কমান্ডো ফোর্সগুলোর একটি৷ এর কারণ, কনভেনশনাল যুদ্ধগুলো ছাড়াও দেশের ভেতরেও তাদেরকে প্রতিনিয়ত জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদীদের মোকাবেলা করতে হয়, আর প্রায় সব কাউন্টার টেররিজম অপারেশনের দায়িত্বই এসএসজি-র কাঁধে এসে পড়ে।

তাদের পরিচালিত অপারেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল লাল মসজিদে চালানো জঙ্গিবিরোধী অভিযান অপারেশন সাইলেন্স। ২০০৭ সালের ৩ থেকে ১১ জুলাই – টানা নয়দিন ধরে এই অপারেশন কার্যকর ছিলো। এই নয়দিন শহরটি রীতিমতো থমকে গিয়েছিল। রাজধানী হওয়ায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকিছুই অবস্থিত ছিল ইসলামাবাদে। আইএসআই-এর হেডকোয়ার্টারের কাছেই লাল মসজিদে অবস্থান নিয়ে ছিলো কয়েকশত সশস্ত্র যোদ্ধা, যারা সরাসরি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল৷ তাদের সাথে ছিল হাজারো মাদরাসা ছাত্র-ছাত্রী। সশস্ত্র যোদ্ধাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, রকেট লঞ্চার ও এন্টি ট্যাংক মিসাইল ছিল যার ফলে এসএসজি-কে মসজিদটি দখলে নিতে প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থলে উগ্রবাদীদের এমন শক্তিশালী একটা অবস্থানে বিস্মিত হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক হাইকমান্ডও!

Abdul Aziz

সাল ২০০৬, আবদুর রশীদ ও আবদুল আজিজ নামে দুইভাই লাল মসজিদ এবং তার পার্শ্ববর্তী জামিয়া হাফসা মাদরাসায় অবস্থান নেয়। তাদের সাথে ছিল কয়েকশত সশস্ত্র যোদ্ধা এবং হাজার হাজার মাদরাসা ছাত্র। তারা সরাসরি পাকিস্তান সরকারকে শত্রু ঘোষণা করে। মসজিদটিতে তারা নিজস্ব আদালত স্থাপন করে এবং তাতে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে অপরাধী ঘোষণা করে। তারা সরকারের পদত্যাগ এবং সারাদেশে শরিয়া আইন জারির দাবি জানাতে থাকে। ইসলামাবাদের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও চালায়। একপর্যায়ে তারা চীনের হেলথ কেয়ার সেন্টারের নারী কর্মীদের অপহরণ এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে হামলা চালিয়ে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ডকে হত্যা করলে অ্যাকশনে যায় সেনাবাহিনী।

০৩ জুলাই থেকে লাল মসজিদ ও জামিয়া হাফসা মাদরাসার চারপাশে অবরোধ বসায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী৷ অভিযানের মূল দায়িত্ব ছিল একটি এসএসজি কোম্পানির ১৬৪ জন সদস্যের উপর। এছাড়াও চারপাশে রেঞ্জার্সসহ কয়েক হাজার সেনা ও পুলিশ সদস্য অবস্থান নেয়। ভেতরে নিরস্ত্র মাদরাসা ছাত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে এসএসজি শুরুতে সরাসরি অভিযান শুরু করেনি। সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং ভেতর থেকে মাদরাসা ছাত্রদের নিরস্ত্র অবস্থায় বেরিয়ে আসলে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। বেশ অনেকজন এভাবে বেরিয়ে আসে। সশস্ত্র যোদ্ধাদের নেতা দুই ভাইয়ের একজন, আবদুল আজিজ বোরকা পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। ইতোমধ্যে হাজারখানেক নিরস্ত্র মাদরাসা ছাত্র বেরিয়ে আসে৷ ভেতরে তখন কয়েকশত সশস্ত্র যোদ্ধা। এসএসজি এবার সরাসরি অভিযানের প্রস্তুতি নেয়।

০৩ জুলাই থেকে ০৯ জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে উভয়পক্ষে গুলিবিনিময় চলছিল। তবে এই দিনগুলোতে মূলত মাদরাসা ছাত্র ও আশপাশের মানুষদেরকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় সেনাবাহিনীকে। আর মূল অপারেশন ছিল ১০ ও ১১ জুলাই এই দুইদিনের। জুলাই ১০, ভোরে এসএসজি কমান্ডোরা মসজিদ ও মাদরাসার সীমানাদেয়াল গুঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তাদেরকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। প্রচুর গুলি, গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চারের আঘাত সইতে হয় কমান্ডোদের। বিশেষ করে লাল মসজিদটির সুউচ্চ মিনারে যোদ্ধাদের স্নাইপারসহ শক্তিশালী পজিশন ছিল যেটি দখলে নিতে এসএসজি-র বেশ বেগ পেতে হয়৷ তবে তারা তার চেয়েও বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাশের জামিয়া হাফসা মাদরাসায়। শেষপর্যন্ত ১১ জুলাই তাদের নেতা আবদুর রশীদসহ বেশ কয়েকজন সশস্ত্র যোদ্ধা নিহত হয় এবং বাকিরা আটক হয়। মসজিদ ও মাদরাসা ভবন সম্পূর্ণ এসএসজি-র আয়ত্ত্বে আসে।

অভিযানে এসএসজির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হারুন-উল ইসলাম সহ ১০ কমান্ডো এবং একজন রেঞ্জার প্রাণ হারান। সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিহতের সংখ্যা ছিল ৯০-১২০ এর মধ্যে। অবশ্য বিদেশি একটি গণমাধ্যম দাবি করে যে ৩০০-র মতো সশস্ত্র যোদ্ধা নিহত হয়েছে। এছাড়াও একটি বোমা হামলায় ১৪ জন সিভিলিয়ানের মৃত্যু হয়, আহত হয় দুই শতাধিক। এমনকি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বিমানেও গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল, যদিও তিনি অক্ষত ছিলেন।

পাকিস্তানে এর আগ পর্যন্ত জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রায় সবটাই ছিল উত্তর-পশ্চিমের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ কেন্দ্রিক, বিশেষত আফগান সীমান্তবর্তী ফাতা (Fedarally Administrated Tribal Areas – FATA) অঞ্চলে। কিন্তু রাজধানী শহরের মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে এত শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেই প্রথম। এই অপারেশনটি করতে হয়েছিল এত জনবহুল একটা এলাকায়, তার ওপর মসজিদের মতো পবিত্র একটি স্থানে৷ এছাড়াও ছিল কয়েক হাজার নিরস্ত্র মাদরাসা ছাত্রের প্রাণরক্ষার ব্যাপার। সব মিলিয়ে অপারেশনটি এসএসজি-র জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ ছিল, দেরিতে হলেও যাতে সফল হয়েছিল তারা।

পাকিস্তান বেশ কয়েকবছর ধরেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এসব অপারেশনে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছে। এদিকে আবার বিভিন্ন জঙ্গি কর্মকাণ্ডে স্বয়ং পাকিস্তান সরকারেরই সমর্থনের অভিযোগও আছে। সেই গল্প জানতে চাইলে কমেন্ট করে আমাদেরকে জানান। ধন্যবাদ।

Facebook Comments

comments