নিচের ছবিটির দিকে তাকান। লন্ডনের বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজের নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি হকার হান্টার যুদ্ধবিমান। যদিও এটা একটা আর্টওয়ার্ক। ঘটনাটির কোন প্রকৃত ছবি পাওয়া যায় নি বলে পাইলটের বর্ণনা মোতাবেক আর্টওয়ার্কে সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন গ্যারি ইজন।

১৯৬৮ সালের ১ এপ্রিল ছিল ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কিন্তু পাইলটদের ইচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন ফ্লাইপাস্টের কোন আয়োজন ছিল না, শুধু ডিনার ও প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছিল। এক নম্বর স্কোয়াড্রনের পাইলটরা ৪ এপ্রিল নিজ উদ্যোগে ওয়েস্ট সাসেক্সের টেংমেয়ার বিমানঘাঁটিতে একটা ফ্লাইপাস্টের আয়োজন করেছিলেন বটে, কিন্তু সরকারিভাবে কিছু না হওয়ায় বিমান বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন ক্ষুব্ধ। কিন্তু সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যালান পোলক (দ্বিতীয় ছবি)। তিনি তখন এক নম্বর স্কোয়াড্রনের সিনিয়র অপারেশনাল ফ্লাইট কমান্ডার। টেংমেয়ারের আনঅফিশিয়াল ফ্লাইপাস্টের উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অ্যালান পোলক

পোলক সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিবাদস্বরূপ কিছু করবেন, যাতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তিনি জানতেন এজন্য তিনি চাকরি হারাতে পারেন। এমনকি কোর্ট মার্শালও হতে পারে। কিন্তু তাঁর তরুণ মন তখন বেপরোয়া।

৫ এপ্রিল অ্যালান পোলকসহ তাঁর স্কোয়াড্রনের কয়েকজন পাইলটের ফ্লাইট ছিল ওয়েস্ট সাসেক্সের টেংমেয়ার বিমানঘাঁটি থেকে নরফোকের ওয়েস্ট রেইনহামে এক নম্বর স্কোয়াড্রনের হোম বেইসে। যাত্রাপথে ছিল লন্ডন শহর। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন লন্ডনের পার্লামেন্ট ভবন, ডাউনিং স্ট্রিটসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনার ওপর দিয়ে খুব অল্প উচ্চতায় কয়েকটা চক্কর দেবেন। শব্দ দিয়ে সবাইকে ভড়কে দিয়ে জানাবেন প্রতিবাদ। এরই অংশ হিসেবে তিনি ফরমেশন থেকে আলাদা হয়ে একা উড়ে যান লন্ডনে। যদিও তখন অন্য পাইলটদের বলেছিলেন তিনি সংযোগ হারিয়ে ফেলেছেন।

পোলক প্রথমেই উড়ে যান পার্লামেন্ট ভবনের দিকে। মজার ব্যাপার, পার্লামেন্ট ভবনে তখন শব্দদূষণ কমানো বিষয়েই আলোচনা চলছিল। ঠিক তখনই পোলকের হান্টার অত্যন্ত নিচ দিয়ে পরপর তিনবার চক্কর দিয়ে পুরো ভবন কাঁপিয়ে যায়। পাশের প্রায় সাড়ে তিনশ’ ফুট উঁচু মিল্কব্যাংক ভবন তিনি সতর্কতার সাথে এড়িয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের ওপর গিয়ে চক্কর দেন। এ সময় পোলক তাৎক্ষণিকভাবে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট ম্যাপে খুঁজে পান নি বলে সে যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ‘বেঁচে’ যায়। তারপর হোয়াইট হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেমোরিয়ালের ওপর দিয়ে ফ্লাই করেন। এ সময় প্রাণ হারানো সৈনিকদের সম্মানে তাঁর বিমান দিয়ে ফ্লাইং স্যালুট প্রদান করেন।

এরপর শুরু করেন শহরের ব্রিজগুলোর ওপর দিয়ে খুব কম উচ্চতায় ফ্লাই করা। একে একে হাঙ্গারফোর্ড, ওয়াটার লু, ব্ল্যাকফ্রিয়ার ও সাউথ ওয়ার্ক ব্রিজের সামান্য ওপর দিয়ে ফ্লাই করেন। টেমস নদীর ওপর পানির উপরিতলের খুব কাছ দিয়ে ফ্লাই করছিলেন তিনি। শহরবাসী এক পাইলটের পাগলামি দেখতে থাকে।

তারপরই সেই মুহূর্ত। পোলক ম্যাপে দেখলেন টাওয়ার ব্রিজ আর সাত সেকেন্ডের দূরত্বে। প্রথমে তাঁর চিন্তা ছিল ব্রিজের ওপর দিয়েই ফ্লাই করার। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মাথায় খেলে যায় দুঃসাহসী চিন্তা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন, ব্রিজের ওপরের হাঁটাপথ এবং নিচের গাড়ি চলার পথের মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে যাবেন। দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি আর কখনো।

তাকিয়ে দেখলেন টাওয়ার ব্রিজে তখন শুধু একটা লাল দোতলা বাস। মুহূর্তেই তিনি তাঁর হান্টার নিয়ে ঘন্টায় সাড়ে ছয়শ’ কিলোমিটার বেগে ব্রিজের মধ্যবর্তী জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে যান।

শহরবাসীর বিস্ময় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। ব্রিজে থাকা এক সাইক্লিস্ট ঘটনার আকস্মিকতায় রাস্তার ওপর পড়ে হালকা আঘাত পান। নদীতে থাকা জাহাজগুলোর ক্রু-রাও তখন বিস্ময়াভিভূত। ব্রিজ ক্রস করার সময় ওপরের ওয়াকওয়ের সাথে বিমানের পেছনের ফিনের এত কম দূরত্ব ছিল যে পোলকের মনে হয়েছিল ব্রিজের সাথে তাঁর বিমানের সংঘর্ষ হবে। শেষপর্যন্ত যদিও তা হয় নি।

আরো কয়েকটি বিমানঘাঁটির ওপর দিয়ে ফ্লাই করে কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর ঘাঁটি রেইনহামে ল্যান্ড করেন। সাথে সাথেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি জানতেন তাঁকে কোর্ট মার্শাল করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন তিনি সেখানে সব ব্যাখ্যা করবেন। চাকরি ফেরত পাওয়ার আশা তিনি করেন নি, তবে চেয়েছিলেন সেখানে সব প্রকাশ করবেন। কিন্তু জনগণ এর আগেই তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয়, পার্লামেন্টেও তাঁর পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ফলে কর্তৃপক্ষ নিজেদের দোষ ঢাকতে সুকৌশলে তাঁকে দুদিনের জন্য অন্তরীণ রেখে পরে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু তাঁকে আর কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করে নি।

বর্তমানে ৮৪ বছর বয়স্ক অ্যালান পোলক জানান, তিনি হকার হান্টারের মতো একটা বিমান ফ্লাই করে যেমন গর্ববোধ করেন, তেমনি সেদিনের ঘটনাটার জন্যও । চাকরি হারানোয় তাঁর কোনো আফসোস নেই।

সত্যিই তো, এই ঘটনার জন্যই তো বিমান বাহিনী তাঁকে নিয়ে গর্ব করে। তাঁর তো কোন আফসোস থাকার কথা নয়।

তাঁর মতো দুঃসাহস কজনই বা দেখাতে পারে?

Facebook Comments

comments