নব্বই এর দশকের শেষের দিকে সরকার আমাদের নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজ বিএনএস বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ কোরিয়া হতে ডেলিভারি পায়। জাহাজটির আসল নাম ছিল উলশান ক্লাস যা সেসময় দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক জাহাজ ছিল। একবার হলেও কি ভেবে দেখেছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সক্ষমতা তাহলে কতদূর হবে! হ্যা, আজকে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া না পুরো পৃথিবীতে সার্ভিসে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ারের ব্যাপারেই আলোচনা করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এ দানবগুলোর নাম সেজং দ্য গ্রেইট ক্লাস। এরকম মোট তিনটি দানবাকৃতির যুদ্ধজাহাজ সার্ভিসে রেখেছে দেশটি। এই সেজং দ্য গ্রেইট এর কাছে ফায়ারপাওয়ার এর দিক থেকে আমেরিকার টিকোনদেরোগা ক্লাস ক্রুজার, জুমওয়াল্ট ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, আর্লে বার্ক ক্লাস ডেস্ট্রয়ারও হেরে গেছে! সেজং দ্য গ্রেইট ক্লাস ডেস্ট্রয়ারগুলো KDX-III নামেও পরিচিত। আক্ষরিকভাবে এই শ্রেণীর ডেস্ট্রয়ারগুলো ভূমি, সমুদ্র, আকাশের প্রায় সবকিছুর বিরুদ্ধে নিজের সক্ষমতা দেখাতে পারে। এটি আমেরিকান নেভির মেরুদন্ড আর্লে বার্ক ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে তবে এতে জাপানের আতাগো ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের কিছু কম্পোনেন্টের সরাসরি মিল রয়েছে।
Sejong The Great বা KDX-III ডেস্ট্রয়ারের Vertical Launch Cell যার ভেতর মিসাইল খাড়াভাবে থাকে এবং উতক্ষেপন করা হয় সেগুলোর সংখ্যা ১২৮ টি! যেখানে জাপানের আতাগো ও আমেরিকার আর্লে বার্ক ডেস্ট্রয়ারে যথাক্রমে ৯০ ও ৯৬টি এবং টিকোনদেরোগা ক্লাস ক্রুজারের ভিএলএস ১২০ টি! মজার বিষয় হল, এই KDX-III জাহাজগুলোর ওজন লোডেড অবস্থায় ১২০০০ টন! একে একেবারে ম্যামথ বলা যায় যেখানে বাকি জাহাজগুলো ১০০০০ টনের মাঝেই সীমাবদ্ধ! অন্যান্য জাহাজগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘Phalanx’ Close In Weapons System-CIWS যা দ্বারা ধেয়ে আসা মিসাইল গুলি করে ধ্বংস করে দেয়া হয় কিন্তু এই ডেস্ট্রয়ার গুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সেরা Goalkeeper CIWS! সেইসাথে ডেস্ট্রয়ারটি অপারেট করতে প্রয়োজন হয় ৩০০ জন ক্রু’র!
COMMAND & CONTROL:
KDX-III ডেস্ট্রয়ারগুলোতে লকহিড মার্টিন এর ডেভেলপকৃত AEGIS COMBAT SYSTEM রয়েছে। এজিস কম্ব্যাট সিস্টেমে SPY-1 রাডার সিস্টেম ও এর কম্পোনেন্ট SPY-1D(V) ট্রান্সমিটার, Mark-99 ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম থাকে। রাডারটি এয়ারক্রাফট ও মিসাইল বা ফ্লায়িং অবজেক্ট গুলো ট্র্যাক করে এবং এর সাথে সংযুক্ত Mk41 VLS এর মাধ্যমে টার্গেট গুলোতে মিসাইল ছুড়ে দেয়। এটি বিশ্বের সমস্ত Friendly AEGIS যুক্ত যুদ্ধ জাহাজের সাথে লিংকড ও মিসাইল ফায়ার করতে সক্ষম!
ওয়েপন, প্রোপালশন, ফায়ার কন্ট্রোল প্রভৃতি সবকিছুই পুরোপুরি অটোমেটিক, নেটওয়ার্ক দ্বারা এজিস ইনফরমেশন সেন্টারের সাথে সংযুক্ত। এই এক সিস্টেম দিয়েই জাহাজ পরিচালনা, অস্ত্র ব্যাবহার, পরিবর্তন, টার্গেট সিলেকশন, জাহাজ চালনা প্রভৃতি কাজ করা যায়। এর ভার্সনটি হল Aegis Baseline 7 Phase 1 এবং এই সিস্টেমটি শত্রুকে শনাক্ত, চিহ্নিতকরন, অবস্থান নির্ণয়, অ্যাটাক করতে সাহায্য করে এবং এজন্য ক্রুদের কোনো ইনপুট দিতে হয়না শুধুমাত্র অ্যাটাকের জন্য ডিসিশন ইনপুট দিতে হয়! যার কারনে ক্রুদের কাজের চাপ বহুগুণে কমেছে। ব্যাবস্থাটি কয়েক হাজার টার্গেটকে শনাক্ত করে প্রায় ১০০টি টার্গেটকে একসাথে একইসময়ে আক্রমণ করতে পারে। পূর্বের গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজের মত এগুলোকেও ক্রুদের দ্বারা এজিস অফলাইন অবস্থায় ম্যানুয়ালি অপারেট করা সম্ভব। এ জাহাজে মেরিটাইম এয়ার সাপোর্ট অপারেশন সেন্টার MASOC রয়েছে যার মাধ্যমে এগুলো সকল স্বপক্ষীয় বিমানের সাথে স্যাচুরেশন এটাক ও অপারেশনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
SENSORS:
একটি AN/SPY-1D 4 প্যানেলের Passive Electronically Scanned Array-PESA রাডার জাহাজের একটি মাস্তুলের চারপাশে লাগানো থাকে। এর পাশাপাশি AN/SPG-62 I/J ব্যান্ডের ফায়ার কন্ট্রোল রাডার রয়েছে। এছাড়াও Atlas Electronic এর তৈরি DSQS-21 BZ-M সোনার যেটি জাহাজের সামনে, নিচের দিকে Bow’তে লাগানো থাকে। ডেস্ট্রয়ার টিতে MTeQ নামক একটি Towed Array Sonar রয়েছে যেটি বিশেষ একধরনের তারের মাধ্যমে জাহাজের পেছন দিকে ছেড়ে দেয়া হয় অনেক দূর পর্যন্ত। এতে একটি SAGEM নামক Infrared Search & Track-IRSR হিট সিকার সেন্সর রয়েছে। এটি যেহেতু প্যাসিভ সেন্সর তাই জাহাজটির সার্ভাইভাবিলিটি এবং সিচুয়েশনাল এওয়ারনেস বা সতর্কতার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি এমনকি সর্বোচ্চ Emission Control-EMCON স্টেট অবলম্বন করলেও এই জাহাজের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।
ENGINE/ PROPULSION:
সেজং দ্য গ্রেট বা কেডিএক্স-থ্রি ডেস্ট্রয়ারগুলোর মূল প্রোপালশন সিস্টেম হল ৪টি General Electric LM-2500 গ্যাস টার্বাইন যা দুটি শ্যাফট চালিত করে প্রোপেলার ঘোরায়। এগুলোর সম্মিলিত শক্তির পরিমাণ ১০০,০০০ অশ্বশক্তি! এছাড়াও তিনটি Rolls-Royce AG9140RF গ্যাস টার্বাইন ইলেক্ট্রিক জেনারেটর রয়েছে, কারণ অপর একটি GE LM-2500 গ্যাস টার্বাইনের দ্বারা জাহাজটির দরকারি বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ একা উৎপন্ন করা সম্ভব নয়। জাহাজটিতে এত পরিমাণ জ্বালানী নেয়া হয় যা দ্বারা এটি ২০ নট গতিতে ৫৫০০ মাইল বা ১০১৮৬ কি.মি. পাড়ি দিতে পারে। জাহাজটির সর্বোচ্চ গতি ৩০ নট। জাহাজটিতে দুটি Rudder বা হাল রয়েছে যার মাধ্যমে অল্প জায়গায় এটিকে ঘুরানো সম্ভব।
WEAPONS:
প্রথমত জেনে রাখা দরকার, জাহাজটিতে মোট ১২৮ টি জাহাজের ডেকের খাড়া মিসাইল উতক্ষেপনের ব্যবস্থা আছে যাকে বলাহয় Vertical Launch System-VLS. এগুলোর বিশেষত্ব হল এগুলো জাহাজের ডেকের জায়গা বাচায়!
মোট VLS- 128 সেল, যার মধ্যে
৪৮ টি Mk-41 VLS সামনে,
৩২ টি Mk-41 VLS পেছনে এবং
৪৮ টি K- VLS পেছনে অবস্থিত।
এই ম্যাসিভ ৩ VLS প্যাডের কম্বিনেশন Kirov ক্লাস ব্যাটলক্রুজারের পরেই এই ডেস্ট্রয়ারকে অবস্থান করে দিয়েছে। সিজং দ্য গ্রেট ক্লাস ডেস্ট্রয়ারগুলোতে বিভিন্ন ধরণের মিসাইল থাকে যার মধ্যে-
◽RIM-66M-5/SM-2ER Block IV Standard আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল রয়েছে যেগুলোর রেঞ্জ ২৪০ কিমি।
◽SSK-700K Haeseong এন্টিশিপ মিসাইল রয়েছে যেগুলোর রেঞ্জ ১৫০ কিমি।
◽K-ASROC এন্টি সাবমেরিন মিসাইল রয়েছে যেগুলো ১৮.৫ কিমি দূরে উড়ে গিয়ে Red Shark টর্পেডো ছুড়ে দিতে পারে উল্লেখ্য, Red Shark এর রেঞ্জ আরো ১৮.৫ কিমি।
◽K745 Blue Shark টর্পেডোও রয়েছে এগুলো শুধুমাত্র টর্পেডো লঞ্চার থেকে ছুড়ে দেয়া হয়, রেঞ্জ ১৮.৫ কিমি।
ডেস্ট্রয়ার টিতে পয়েন্ট ডিফেন্স হিসেবে আছে বিশ্ববিখ্যাত Goalkeeper CIWS যা প্রতিমিনিটে ৬০০০-৮০০০ রাউন্ড ৩০ মি.মি. গোলা ছুড়ে এন্টিশিপ মিসাইল হতে ডেস্ট্রয়ার টিকে রক্ষা করতে সক্ষম!
এছাড়াও RIM-116B ৭.৪ কিমি রেঞ্জ এর পয়েন্ট ডিফেন্স মিসাইল রয়েছে যেগুলো আলাদা লঞ্চারে থাকে এবং এগুলোর জন্য VLS এর দরকার হয়না। একেকটি RAM লঞ্চারে ২১ টি মিসাইল থাকে।এই মিসাইলগুলো খুবই কার্যকরী রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
একেবারে সামনে একটি ১২৭ মিমি L62 Mk-45 Mod 4 নেভাল ক্যানন রয়েছে। যার মাধ্যমে ২৪ কিমি দূরে প্রতি মিনিটে ১৬-২০ টি গোলা ছোড়া যায়! একটি ASROC এন্টি সাবমেরিন রকেট লঞ্চার জাহাজের পেছনে বসানো থাকে, লঞ্চারে একবারে ১৬টি রকেট নিক্ষেপ করা যায়। অর্থাৎ,
◽4×4=16টি Haeseong Anti-ship Missile
◽1×21 RIM-116 RAM block-1 SAM
◽48+32 Mk41 VLS এ SM2 Block 3B/4 SAM
◽48 টি K-VLS যেগুলোতে 32×1 Hyunmoo III ল্যান্ড এটাক ক্রুজ মিসাইল ও 16×1 K-ASROC এন্টি সাবমেরিন মিসাইল থাকে।
◽2×3=6 Blue Shark Torpedo
◽1×1 Goalkeeper CIWS
◽1×1 Mk5 Mod-4 Naval Gun
উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন রুখে দেয়ার জন্য ভবিষ্যতে SM-3 block1A ২৫০০ কি.মি. রেঞ্জের ম্যাক ১৪ গতিসম্পন্ন এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সংযোজন করার পরিকল্পনা করেছে দেশটি।
AVIATION:
Sejong The Great/ KDX-III ডেস্ট্রয়ারগুলোতে নিখুঁত এন্টি সাবমেরিন অপারেশন পরিচালনার জন্য দুটি Westland Lynx হেলিকপ্টার থাকে। এর হেলিকপ্টার ডেক বিশাল আকারের এবং হেলিকপ্টার দুটির জন্য হ্যাঙ্গারের ব্যাবস্থা রয়েছে।
“উল্লেখ্য, শুধুমাত্র কিরভ ক্লাস ব্যাটলক্রুজার অস্ত্রের পরিমাণের দিক দিয়ে এর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে!”
কিছু ছবিঃ
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.