আধুনিক যুগের যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের প্রথম ব্যবহার করেছিলো ব্রিটিশরা ১৯১৬ সালে। এরপর থেকেই ক্রমাগত ট্যাংকের ডিজাইনের উন্নতি হতে থাকে এবং কালক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বশক্তিগুলো নতুন ও তুলনামূলক শক্তিশালী ট্যাংক নিয়ে যুদ্ধে হাজির হয়।
শক্তিশালী ও শত্রুদের নিকট যম হিসাবে পরিচিত লাভ করা জার্মান টাইগার ট্যাংকগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ট্যাংক হিসাবে পরিচিত ছিলো৷ মানের দিক থেকে এদেরকে টক্কর দিতে না পারায় মিত্রশক্তি চিন্তা করলো সংখ্যা দিয়ে এদের ধরাশায়ী করার৷ তাই যুক্তরাষ্ট্র হাজির হয় তাদের এম-৪ শেরম্যান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করে টি-৩৪ ট্যাংক৷ এই দুটি ট্যাংকই যুদ্ধে বিপুল পরিমানে তৈরি করা হয়েছিলো জার্মানীর তৈরি টাইগার ট্যাংকের বহরকে আটকানোর জন্য।
German Tiger Tank
জার্মানীর বিরুদ্ধে ইউরোপ যুদ্ধ ঘোষনা করলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে ৭৬% জনগন নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে ভোট দেয়৷ পরে জাপানের আক্রমনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ঘোষনা দিলেও যুদ্ধের ট্যাংকের বহর ছিলো পুরানো এবং সেই সময়ের তুলনায় পিছিয়ে৷ যুক্তরাষ্ট্র মূলত সে সময় সামরিক শক্তির বদলে শুধু অর্থনীতির উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছিলো৷ তাই সে সময় প্রয়োজন ছিলো একটি সময়োপযোগী ট্যাংকের, কাজেই সে অভাব পূরন করতে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে M-3 LEE নামক ট্যাংক যা তৈরি করা হয়েছিলো স্বল্প সংখ্যায় এবং শুধু স্টেপ গ্যাপ হিসাবে৷
কিছুদিনের মধ্যেই M-3 LEE এর আপগ্রেড হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র M-4 SHERMAN নামক ট্যাংক তৈরি করে যা গনউৎপাদন বা মাস প্রোডাকশনের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ ফলস্বরূপ ডেট্রয়েট ট্যাংক আর্সেনাল ছাড়াও বিভিন্ন স্টিল কোম্পানি, রেলওয়ে লোকোমোটিভ এবং অটোমোবাইল কোম্পানি সহ ১০০ এর বেশি সাবকন্ট্রাক্টরকে শেরম্যান ট্যাংকের গন উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করা হয়৷ এই ট্যাংক তৈরির পর তা যুক্তরাষ্ট্রের সেনা, মেরিনসহ ব্রিটেন এবং বিভিন্ন কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নকেও দেওয়া হয় যুদ্ধ লড়াই করার জন্য। এই ট্যাংক তৈরির জন্য মোট ৪,৫৩৭ টি পার্টসের প্রয়োজন হয় যা একটি লম্বা এসেম্বলি লাইন বসিয়ে অধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কম সময়ের মধ্যেই তৈরি করে ফেলা যায়৷
শেরম্যান ট্যাংকের বিশেষত্ব হচ্ছে এর সিম্পল ডিজাইন ও ইজি মেনটেইনেন্স তাই অনেক সময় সাধারন প্রশিক্ষিত সেনারাও যুদ্ধকালীন সময়ে ট্যাংকে হওয়া ছোটখাট ক্রুটি নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারতো৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫০,০০০ এর কাছাকাছি শেরম্যান ট্যাংক তৈরি করা হয় যার ১৯,২৪৭ টি পায় ইউএস আর্মি, ১১১৪ টি পায় ইউএস মেরিন, ১৭১৮৪ টি দেওয়া হয় গ্রেট ব্রিটেনকে, ৪১০২টি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাকিগুলো পায় যথারীতি কানাডা এবং চীন। বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ট্যাংককে একটি মাল্টিপারপাস প্ল্যাটফর্ম হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে৷ সময়ের প্রয়োজনে একে মাইনসুইপার, বুলডোজার এমনকি এম্ফিবিয়াস ভার্সন এবং MLRS ভার্সনেও তৈরি করা হয়৷
Minesweeper Version Of Sherman
এই ট্যাংকে মূল অস্ত্র হিসাবে রয়েছে ৭৫ বা ৭৬ মিমি কামান (ভ্যারিয়েন্ট ভেদে) এমনকি এতে ১০৫ মিমি হাউইটজার কামানও যুক্ত করা হয়েছিলো কিছুক্ষেত্রে৷ কামানের পাশাপাশি রয়েছে কো-এক্সিয়াল .৩০ ক্যালিবারের M-1919 মেশিনগান এবং নিচেও এমন আরেকটি মেশিনগান সংযোজন করা হয়৷ ট্যাংকের টারেটের উপর এন্টি-এয়ারক্রাফট এবং এন্টি-পারসোনাল ওয়েপন হিসাবে এম-২ ব্রাউনিং হেভি মেশিনগান ব্যাবহার করা হয়৷ এটি মূলত একটি মিডিয়াম ওয়েট ট্যাংক যার ওজন ছিলো মাত্র ৩৩টন।
শেরম্যান ট্যাংক দিয়ে লড়া প্রথম যুদ্ধ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির নর্থ আফ্রিকান ক্যাম্পেইন এ৷ যুদ্ধে এই ট্যাংকের মূল প্রতিপক্ষ ছিলো হিটলারের প্যানজার ট্যাংকের ডিভিশন৷ এই যুদ্ধে শেরম্যানের পারফরমেন্স তুলনামূলক সন্তোষজনক ছিলো যেহেতু প্যানজার ট্যাংক ছিলো তুলনামূলক হালকা এবং শেরম্যানের তুলনায় কিছুটা দূর্বল৷ তবে সময়ের সাথে সাথে জার্মানী আরো শক্তিশালি এবং ভারী ট্যাংক তৈরি করতে থাকে যার ফলে যুদ্ধে শেরম্যানের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায় টাইগার সিরিজের ভারী ট্যাংকগুলো৷ তাই সে যুদ্ধ শেরম্যান ট্যাংকের পক্ষে জয় করা কঠিন হয়ে যায়৷
German Tank Division
ড্রাইভারের দক্ষতা বাদ দিলে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে মূলত মোবিলিটি, ফায়ারপাওয়ার এবং আর্মরের দিক দিয়ে৷ সে যুদ্ধে টাইগার ট্যাংক ফায়ারপাওয়ার এবং আর্মরে এগিয়ে ছিলো এবং শেরম্যান এগিয়ে ছিলো মোবিলিটির দিক দিয়ে৷ তবে টাইগারের ভারী আর্মরের ফলে এর বডি ভেদ করতে প্রায়ই শেরম্যান ট্যাংক ক্রুদের বেগ পেতে হতো৷ তাছাড়া টাইগারের হাইভেলোসিটি প্রোজেক্টাইল শেরম্যানের যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম ছিলো৷ তাই সেনারা ট্যাংকের বডিতে প্রায়ই অতিরিক্ত আর্মর প্লেট অথবা বালুর বস্তা লাগিয়ে নিতেন অতিরিক্ত সুবিধার জন্য ৷ প্রতিটি টাইগার ট্যাংককে ধরাশায়ী করতে ৪-৫টি শেরম্যান ট্যাংকের প্রয়োজন পড়তো৷
Sherman With Sandbags
নর্থ আফ্রিকান ক্যাম্পেইনের পর থেকে বড় বড় সব যুদ্ধ বিশেষ করে ইনভেশন অব নরম্যান্ডি ডি-ডে তেও এই ট্যাংকের অনেক ব্যবহার করা হয়৷ যুদ্ধের পরও কোরিয়ান ওয়ার এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে শেরম্যান ট্যাংকের বিপুল মাত্রায় ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷
“মজার বিষয় হলো, আপনি চাইলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এই শেরম্যান ট্যাংক এর সৌভাগ্যবান মালিক হতে পারবেন যেটা সম্পূর্ণ চালনা যোগ্য! তবে তার জন্য আপনাকে গুনতে হবে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.