এই ডেস্ট্রয়ারটি চাইনিজ পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি সার্ফেস ফোর্সের গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। এগুলো সত্যিকারের ব্লু ওয়াটার নেভির যোগ্য ডেস্ট্রয়ার। এগুলোর হাল এবং প্রোপালশন একে ভালমানের সামুদ্রিক সক্ষমতা, ভাল ম্যানিউভারিবিলিটি প্রদান সহ এর ফায়ারপাওয়ার একে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছে। যা যুদ্ধকালীন সময়ে এর শত্রুপক্ষের জন্য একে মারাত্মক ভয়ঙ্কর করে তুলবে।
প্রোপালশনঃ জাহাজটিতে দুটি QC-280 গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন আছে যার প্রতিটি ২৮ মেগাওয়াট করে শক্তি উৎপাদন করে। এছাড়াও দুটি MTU 20V 956TB92 ডিজেল ইঞ্জিন রয়েছে যার প্রতিটির আউটপুট ৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এর ইঞ্জিন কনফিগারেশন CODOG (Combined Diesel Or Gas) যা একে প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৩০ নট বা ৫৬ কি.মি. গতি প্রদান করে।
সেন্সরসমুহঃ এর কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেম একাধারে এর ‘Multifunctional Phased Array Radar’ ‘Command and Decision System’ ‘Battlefield Display System’ এবং ‘Weapon Control System’ একীভূত করে। CDS জাহাজের সেন্সরসমূহ থেকে উপাত্ত পেয়ে কমান্ড, কন্ট্রোল ও শত্রুর মূল্যায়ন করে। এটি WCS এ শত্রুকে হামলা করার যাবতীয় বিবরণ দেয় যার মাধ্যমে WSC অস্ত্র নির্বাচন করে। জাহাজটি অন্যান্য জাহাজ বা গ্রাউন্ড স্টেশন এবং বিমানে তথ্য পাঠাতে ডাটালিংক এবং সেন্সর ব্যাবহার করে।
০৫২ডি ডেস্ট্রয়ারের প্রাণ টাইপ-৩৪৬ ড্রাগন আই এক্টিভ ইলেক্ট্রনিক্যালি স্ক্যান্ড অ্যারে রাডার এবং টাইপ- ৫১৭ এল ব্যান্ড রাডারের সংমিশ্রণে গঠিত। এগুলো এইচকিউ-৯বি সার্ফেস টু এয়ার মিসাইলের সাথে একীভূতকরণ করা থাকে। টাইপ-৩৪৬এ ড্রাগন আই রাডারটি আবার আমেরিকান স্পাই-ডি প্যাসিভ ইলেক্ট্রনিক্যালি স্ক্যান্ড এরে রাডারের মত এস ব্যান্ডের! কিন্তু টাইপ-৩৪৬এ কিন্তু AESA!রাডারটি দ্রুতগামী ফাইটার, হেলিকপ্টার, দ্রুতগামী স্পিডবোট, সী স্কিমিং এন্টিশিপ মিসাইল সহ কয়েকশত টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে। রাডারএক্স সিস্টেম টির প্রতি প্যানেলে মোট ৩৪৫৬ টা ট্রান্সফার-রিসিভার মজিউল ও ৬০ সে.মি. এর সি ব্যান্ড ০.৩ স্কয়ার মিটার চওড়া রাডার রয়েছে এইচকিউ-৯বি স্যাম সিস্টেম এর জন্য।
একজন রাশিয়ান এক্সপার্টের মতে, আমেরিকান এফ-৩৫ বিমান ড্রাগন আই রাডারে ধরা পড়বে। যদিও এ নিয়ে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। স্টেলথ জেটগুলো এমনভাবে ডিজাইনই করা হয় যাতে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির রাডারে যেমন C, X ও Ku ব্যান্ড এ শনাক্ত করা না যায়। কিন্তু বিমানের টেইল ফিনগুলো কম ফ্রিকুয়েন্সির S বা L ব্যান্ড রাডারে ধরা পড়লেও পড়তে পারে, তবে সেটা নির্ভর করবে জাহাজ এবং বিমানের দুরত্ব ও ছড়িয়ে পড়া সিগন্যালের ফেরত আসার উপর। যদিও সুবিধাজনক দুরত্বে ধরা পড়ার চান্স কম থাকে কারণ S এবং L ব্যান্ড রাডার এর সেল ভাল কোয়ালিটির ওয়েপন ট্র্যাকিং ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম নয়। আমেরিকান স্পাই-ডি এস ব্যান্ড রাডার আবার এয়ার ও মিসাইল ডিফেন্স রাডারের সাথে হাই ফ্রিকুয়েন্সিতে সমন্বয় করে ওয়েপন ট্র্যাকিং এর কোয়ালিটি ইমেজ বানাতে পারে, অর্থাৎ স্টেলথ টার্গেট শনাক্ত করতে পারে।
চীন এক্ষেত্রে তাদের বড় রেজুলেশনের রাডার সেলগুলো অন্যান্য লো ফ্রিকুয়েন্সি রাডার গুলোর সাথে হাই স্পিড নেটওয়ার্ক কানেক্ট করেছে। যেগুলো রাডারের রেজুলেশন যতটা রিফাইন করে তা দ্বারা হয়ত স্টেলথ টার্গেট ট্র্যাকিং সম্ভব হবে। তবে তা ট্যাক্টিক্যাল ওয়ারফেয়ারে কাজে দিবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় কারণ স্বল্প রেঞ্জে স্টেলথ টার্গেট শনাক্ত করার আগেই শত্রুবিমান হয়ত তার কাজ সেরে ফেলবে।
টাইপ-৫১৭ এল ব্যান্ড রাডার বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক শব্দের নকল ফ্রিকুয়েন্সির রেডিয়েশন এমিট করতে পারে যা মূলত জ্যামিং এর কাজে বা ইসিএম এর কাজে ব্যাবহৃত হয়।
টাইপ-৩৪৪ ফায়ার কন্ট্রোল রাডারটি মূল মাস্তুলের সামনে, উপরে বসানো হয়। স্ট্যান্ডার্ড ফায়ার কন্ট্রোল রাডারের মত এটি ৭৬, ১০০ ও ১৩০মি.মি. ক্যানন ও এন্টি শিপ মিসাইল গুলোকে গাইডেন্স প্রদান করতে বানানো হয়েছে। এটিতে টিভি ট্র্যাকার এবং লেজার রেঞ্জফাইন্ডারও রয়েছে!
টাইপ ০৫২ডি ডেস্ট্রয়ারে আরেকটি অতিরিক্ত রাডার রয়েছে যা সবচেয়ে উপরে অবস্থিত। এটি ট্র্যাকিং রাডার নয়। এটি দিয়ে কয়েকশত থেকে হাজার কিলোমিটারের উপর আবহাওয়াভেদে টার্গেট সার্চ করা যায়।
অস্ত্রশস্ত্রঃ টাইপ ০৫২ডি ডেস্ট্রয়ারে ব্র্যান্ড নিউ VLS বা Vertical Launching System রয়েছে যা আগের টাইপ ০৫২সি এর সোভিয়েত টেকনোলজির গোলাকার রিভলভিং ভিএলএস রিপ্লেস করা হয়েছে। এতে কোয়াড প্যাক লঞ্চিং বা প্রতি সেলে ৪ টি পর্যন্ত মিসাইল লঞ্চিং এর ব্যাবস্থাও রয়েছে! এই ভিএলএসগুলোর কোল্ড লঞ্চ সিস্টেমে আগুন না বের করে স্প্রিং এর মত বাতাসের চাপ দিয়ে ছুড়ে দেয়া হয় যা জাহাজের সুপারস্ট্রাকচারের ছোটখাটো লাইফ ড্যামেজ করেনা। অপশনাল হিসেবে রয়েছে হট লঞ্চ যেখানে এক্সস্ট পাইপ দিয়ে আগুন ও গ্যাস বের হয়ে যায়। এগুলা মার্ক-৪১ ভিএলএসের কাছাকাছি দেখতে। কিন্তু চাইনিজ জাহাজে আলাদা ও আরো আধুনিক এবং নতুন উপায়ে হট লঞ্চ হয় যার নাম Concentric Canister Launch!
YJ-18 এন্টিশিপ ক্রুজ মিসাইল টাইপ ০৫২ডি এর প্রধান অস্ত্র। এগুলো এন্টিশিপ ও ল্যান্ড এটাকের জন্য ব্যাবহার করা যায়। এটির সারা ফ্লাইটে গতি মাত্র ম্যাক ০.৮ তবে টার্মিনাল স্টেজে এর গতি ম্যাক ০৩ তে বাড়িয়ে দেয় যার ফলে একে আটকানো খুবই কঠিন। মিসাইলগুলোর পরিধি ২৬৪২০০ স্কয়ার নটিকাল মাইল অর্থাৎ এই বর্গাকার এলাকার মধ্যে মিসাইলটি হামলা করতে সক্ষম। মিসাইলগুলোর রেঞ্জ ২৯০ নটিক্যাল মাইল। এগুলোকে ইনার্শিয়াল গাইডেন্স দেয়া হয় Beidou স্যাটেলাইট দ্বারা। এতে ৩০০ কিলোগ্রামের হাই এক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড রয়েছে, পাশাপাশি শর্ট রেঞ্জে এন্টি রেডিয়েশন পারফর্ম করার জন্য এন্টি রেডিয়েশন ওয়ারহেডও রয়েছে!
এছাড়াও ল্যান্ড এটাকের জন্য CJ-10 ক্রুজ মিসাইল রয়েছে যেগুলোর রেঞ্জ চীন কম বললেও ২০০০ কিমি এর বেশি রেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়। চীনের দাবী এতে ইনার্শিয়াল গাইডেন্স, স্যাটেলাইট নেভিগেশন, টারেইন ম্যাপিং বা ভূমির অবস্থার ম্যাপ দ্বারা টারেইন হ্যাগিং করে যাওয়া এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্যপট মানচিত্রকরণ বা Digital Scene-Mapping Area Correlator রয়েছে টার্মিনাল গাইডেন্সের জন্য!
CY-1 এন্টি সাবমেরিন মিসাইল রয়েছে যার রেঞ্জ ৩০ কিমি। এছাড়াও একটি HPJ-38 ১৩০ মি.মি. মেইন গান রয়েছে সাথে দুইটি ৩০ মি.মি. রিমোট কন্ট্রোল গান এবং একটি HPJ-12 CIWS বর্তমানে Type-730 & 1130 নতুন শিপগুলোতে সংযোজন করা হচ্ছে।
HQ-9B সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল/ এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইলের রেঞ্জ প্রায় ২০০ কি.মি.! এছাড়াও HHQ-10 এন্টিশিপ মিসাইলনাশক স্যাম রয়েছে। এগুলো পয়েন্ট ডিফেন্স অস্ত্র যেগুলো সুপারসনিক এন্টিশিপ মিসাইল ধ্বংস করে দিতেও সক্ষম। এগুলোর রেঞ্জ ১০ কি.মি. এগুলো জাহাজকে এন্টিশিপ মিসাইল হতে রক্ষা করে।
অ্যাভিয়েশনঃ এই যুদ্ধজাহাজটির হ্যাঙ্গারটি শেষের দিকে সেন্টারলাইনে আনা হয়েছে যেখানে ০৫২সি তে সেটি একপাশে ছিল। এই যুদ্ধজাহাজটি একটি Herbin Z-9 ASW হেলিকপ্টার বহন করে।
পরিশেষে, চায়নার বহরে যুক্ত হওয়া এই টাইপ ০৫২ডি ডেস্ট্রয়ার টি আধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রসজ্জিত হওয়ায় এটি একইসাথে ত্রিমাত্রিক আক্রমণ এবং শত্রুর আক্রমণ রুখে দিতে সমানভাবে কার্যকর হবে আশা করা যায়। এর ম্যানুভারিবিলিটি, ফায়ারপাওয়ার এবং সামুদ্রিক সক্ষমতা একে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর করে তুলেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.